জিহাদ ও কিতাল

জিহাদ কোন ধরনের ফরয?

‘জিহাদ’ সকলের জন্য সর্বাবস্থায় ‘ফরযে আয়েন’ না জানাযার ছালাতের ন্যায় ‘ফরযে কিফায়াহ’ এ বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব বলেন, জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের উপরে সব সময়ের জন্য ফরয। ইবনু আত্বিইয়াহ বলেন, এ বিষয়ে উম্মতের ‘ইজমা’ বা ঐক্যমত রয়েছে যে, উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর জিহাদ ‘ফরযে কিফায়াহ’। তাদের কোন দল উক্ত দায়িত্ব পালন করলে বাকীদের উপর থেকে দায়িত্ব নেমে যায়। তবে যখন শত্রু ইসলামী খেলাফতের সীমানায় অবতরণ করে, তখন প্রত্যেক মুসলমানের উপরে জিহাদ ‘ফরযে আয়েন’ হয়ে যায়।[1] আত্বা ও ছাওরী বলেন, ‘জিহাদ’ ইচ্ছাধীন বিষয়। তাঁরা সূরা নিসা ৯৫ আয়াত থেকে দলীল গ্রহণ করেন। যেখানে জিহাদকারী ও বসে থাকা সকল মুমিনকে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। যুহরী ও আওযাঈ বলেন, আল্লাহ জিহাদকে সকল মুসলমানের উপরে ফরয করেছেন, তারা যুদ্ধ করুক কিংবা বসে থাকুক। যে ব্যক্তি যুদ্ধ করল, সে যথার্থ করল ও আশীষপ্রাপ্ত হ’ল। আর যে ব্যক্তি বসে রইল, সেও গণনার মধ্যে রইল। যদি তার নিকটে সাহায্য চাওয়া হয়, তাহ’লে সে সাহায্য করবে। আর যদি যুদ্ধে বের হওয়ার আহবান করা হয়, তাহ’লে যুদ্ধে বের হবে। আর যদি তাকে আহবান না করা হয়, তাহ’লে বসে থাকবে।[2]

ইবনু কাছীর শেষোক্ত মতকে সমর্থন করে বলেন, সেকারণেই ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ ‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ জিহাদ করল না। এমনকি জিহাদের কথা মনেও আনলো না, সে ব্যক্তি মুনাফেকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করল’।[3] অনুরূপভাবে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘোষণা করেন, لاَ هِجْرَةَ بَعْدَ الْفَتْحِ وَلَكِنْ جِهَادٌ وَنِيَّةٌ، وَإِذَا اسْتُنْفِرْتُمْ فَانْفِرُوا ‘মক্কা বিজয়ের পরে আর হিজরত নেই। কিন্তু জিহাদ ও তার নিয়ত বাকী রইল। যখন তোমাদেরকে জিহাদের জন্য আহবান করা হবে, তখন তোমরা বের হবে’।[4] আল্লাহ বলেনَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلاَ نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُون-َ   ‘আর সমস্ত মুমিনের জন্য জিহাদে বের হওয়া সঙ্গত নয়। অতএব তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের জন্য কেন বের হ’ল না? যাতে তারা ফিরে এসে স্ব স্ব গোত্রকে সতর্ক করতে পারে এবং তারা নিজেরাও বাঁচতে পারে? (তওবাহ ৯/১২২)

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হোযায়েল গোত্রের লেহইয়ান শাখার বিরুদ্ধে একটি সেনাদল পাঠানোর সময় বলেন, প্রতি দু’জনের মধ্যে একজনকে পাঠাবে। কিন্তু নেকী দু’জনের মধ্যে ভাগ হবে’।[5] তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে মদীনার উপকন্ঠে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই মদীনাতে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা তোমাদের সঙ্গে অভিযানে বের হয়নি বা কোন ময়দান অতিক্রম করেনি। অথচ তারা তোমাদের ন্যায় নেকীর অধিকারী। ছাহাবীগণ বললেন, এরূপ লোক কি মদীনাতে আছে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ, তারা মদীনাতেই আছে। বিভিন্ন ওযর তাদেরকে আটকে রেখেছিল।[6] সাইয়িদ সাবিক্ব বলেন, এর কারণ এই যে, যদি জিহাদ প্রত্যেকের উপরে ফরয করা হ’ত তাহ’লে মানুষের দুনিয়াবী শৃংখলা বিনষ্ট হয়ে যেত। অতএব জিহাদ কিছু লোকের উপরেই মাত্র ওয়াজিব, সবার উপরে নয়।[7]

ছহীহ বুখারীর সর্বশেষ ভাষ্যকার আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২ হিঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে জিহাদ ‘ফরযে কিফায়াহ’ হওয়ার মতামতই প্রসিদ্ধ রয়েছে। ... তবে যখন শত্রু ঘেরাও করে ফেলবে তখন ব্যতীত এবং শাসক যখন কাউকে জিহাদে বের হবার আদেশ করবেন তখন ব্যতীত। তিনি বলেন, স্বতঃসিদ্ধ কথা এই যে, কাফিরের বিরুদ্ধে জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের উপর নির্ধারিত। চাই সেটা হাত দিয়ে হৌক বা যবান দিয়ে হৌক বা মাল দিয়ে হৌক কিংবা অন্তর দিয়ে হৌক’।[8] ইমাম শাওকানীও এ কথা বলেন।[9]

উপরের আলোচনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ঈমান, ত্বাহারৎ, ছালাত ও ছিয়ামের ন্যায় ‘জিহাদ’ প্রত্যেক মুমিনের উপরে সর্বাবস্থায় ‘ফরয আয়েন’ নয়। বরং আযান, জামা‘আত, জানাযা ইত্যাদির ন্যায় ‘ফরযে কিফায়াহ’। যা উম্মতের কেউ আদায় করলে অন্যদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। না করলে সবাই গোনাহগার হয়।

এতে বুঝা যায় যে, সশস্ত্র জিহাদ ফরযে কিফায়াহ হ’লেও যবান ও অন্তরের জিহাদ মুমিনের উপর সর্বাবস্থায় ‘ফরযে আয়েন’।



[1]. কুরতুবী, বাক্বারাহ ২১৬ আয়াতের ব্যাখ্যা; ৩/৩৯।

[2]. মুখতাছার তাফসীরুল বাগাভী (রিয়াদ : ১ম সংস্করণ, ১৪১৬/১৯৯৬) বাক্বারাহ ২১৬ আয়াতের ব্যাখ্যা, ১/৭৭।

[3]. মুসলিম হা/১৯১০, মিশকাত হা/৩৮১৩ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[4]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১৫, ৩৮১৮; তাফসীর ইবনু কাছীর ১/২৫৯।

[5]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮০০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১৫-১৬।

[7]. সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৪-৮৫।

[8]. ফাৎহুল বারী হা/ ২৮২৫-এর ব্যাখ্যা, ৬/৪৫ পৃঃ।

[9]. মুহাম্মাদ বিন আলী শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো : ১৩৯৮/১৯৭৮) ৯/১০৫ পৃঃ।