জিহাদ ও কিতাল

মাদানী জীবনে

উপরের আলোচনায় মাক্কী জীবনে জিহাদের প্রকৃতি ফুটে উঠেছে। প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে সেখানে দ্বীনের দাওয়াতকে খুবই ধৈর্য ও দূরদর্শিতার সাথে জনগণের নিকটে পেশ করতে হয়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও যখন কুফরী শক্তি ঈমানদারগণকে বরদাশত করতে পারলো না, বরং তাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেল এবং অবশেষে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করল, তখন আল্লাহর নির্দেশে তিনি মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হন (আনফাল ৮/৩০)। যেখানে পূর্ব থেকেই অন্ততঃ ৭৫ জন নারী-পুরুষ তাঁর হাতে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেছিলেন ও তাঁর জানমালের নিরাপত্তা দানে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলেন। তাছাড়া মুছ‘আব বিন ‘ওমায়ের (রাঃ) সেখানে পূর্ব থেকেই দ্বীনের প্রচারে লিপ্ত ছিলেন ও ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে রেখেছিলেন। যে কারণে মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিপুলভাবে সমাদৃত হন এবং জনসমর্থন ও শক্তি অর্জনে সমর্থ হন। ফলে এখানে যখন ২য় হিজরীতে মক্কার কাফেররা এসে হামলা চালায়, তখন আর তাঁকে পূর্বের মাক্কী জীবনের ন্যায় ছবর ও ক্ষমা করার কথা না বলে বরং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) প্রমুখাৎ হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর উক্তি বর্ণিত হয়েছে যে, যে রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন, সে রাতে আবুবকর (রাঃ) দুঃখ করে বলেছিলেন, أَخْرَجُوْا نَبِيَّهُمْ لَيَهْلِكُنَّ ‘তারা তাদের নবীকে বের করে দিল। এখন অবশ্যই তারা ধ্বংস হবে’। এ সময় সূরা হজ্জ-এর ৩৯ আয়াতটি নাযিল হয়, أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ- الَّذِيْنَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلاَّ أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللهُ وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيْهَا اسْمُ اللهِ كَثِيْرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيْزٌ ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হ’ল তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ তাদের প্রতি যুলুম করা হয়েছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তাদেরকে (যুদ্ধ ছাড়াই) সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম’ (৩৯)। ‘যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ কারণে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা ‘আল্লাহ’। যদি আল্লাহ মানবজাতির একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে নাছারাদের বিশেষ উপাসনালয়, সাধারণ উপাসনালয়, ইহূদীদের উপাসনালয় ও মুসলমানদের মসজিদসমূহ, যে সকল স্থানে আল্লাহর নাম অধিকহারে স্মরণ করা হয়, সবই বিধ্বস্ত হয়ে যেত। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিমান ও পরাক্রমশালী’ (হজ্জ ৩৯-৪০)[1]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ ‘তোমরা যুদ্ধ কর আল্লাহর রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তবে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/১৯০)[2]

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (৭০০-৭৭৪ হিঃ) বলেন, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর এবং তাতে সীমালঙ্ঘন করো না। আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্ত্তকে সিদ্ধ করো না। যেমন বুরাইদাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কোন সেনাদল প্রেরণ করতেন, তখন বলতেন, اغْزُوا بِاسْمِ اللهِ فِى سَبِيلِ اللهِ قَاتِلُوا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ اغْزُوا وَلاَ تَغُلُّوا وَلاَ تَغْدِرُوا وَلاَ تُمَثِّلُوا وَلاَ تَقْتُلُوا الْوِلْدَانَ وَلاَ أَصْحَابَ الصَّوَامِعِ- ‘তোমরা আল্লাহর নামে তাঁর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে। যুদ্ধ কর, কিন্তু গণীমতের মালে খেয়ানত করো না। চুক্তি ভঙ্গ করো না। শত্রুর অঙ্গহানি করো না। শিশুদের ও উপাসনাকারীদের হত্যা করো না’।[3] ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, এক যুদ্ধে এক মহিলাকে নিহত দেখতে পেয়ে রাসূল (ছাঃ) দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং নারী ও শিশুদের থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেন।[4]

উপরে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-এর মাক্কী ও মাদানী জীবন পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ সর্বাবস্থায় ফরয। তবে সেটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কখনো নিরস্ত্র হবে, কখনো সশস্ত্র হবে। নিরস্ত্র জিহাদ মূলতঃ প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াত ও হক-এর উপরে দৃঢ় থাকার মাধ্যমে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে সশস্ত্র জিহাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ, পর্যাপ্ত সামর্থ্য, বৈধ কর্তৃপক্ষ এবং স্রেফ আল্লাহর ওয়াস্তে নির্দেশ দানকারী আমীরের প্রয়োজন হবে। নইলে ছবর করতে হবে এবং আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।


[1]. তিরমিযী হা/৩১৭১; নাসাঈ হা/৩০৮৫; আহমাদ হা/১৮৬৫; হাকেম হা/২৩৭৬।

[2]. তাফসীর কুরতুবী ২/৩৪৭, শাওকানী, তাফসীর ফাৎহুল ক্বাদীর ১/১৯০।

[3]. মুসলিম হা/১৭৩১; আহমাদ হা/২৭২৮; মিশকাত হা/৩৯২৯।

[4]. বুখারী হা/৩০১৫।