জিহাদ ও কিতাল

জিহাদ ও ক্বিতাল : এক নযরে

  1. ইসলামী পরিভাষায় ‘জিহাদ’ অর্থ, আল্লাহর পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো’ এবং ‘ক্বিতাল’ অর্থ আল্লাহর পথে কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা’। দু’টি শব্দ অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে ‘জিহাদ’ বললে দু’টিই বুঝায় এবং ইসলামী পরিভাষায় এটিই অধিক পরিচিত ও সর্বাধিক গ্রহণীয় শব্দ (পৃঃ ১২)
  2. জিহাদের উদ্দেশ্য : আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করা ও তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করা (পৃঃ ১৩)
  3. জিহাদ বিধান : বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ সর্বাবস্থায় ফরয। তবে সেটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কখনো নিরস্ত্র হবে, কখনো সশস্ত্র হবে। নিরস্ত্র জিহাদ মূলতঃ প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াত ও হক-এর উপরে দৃঢ় থাকার মাধ্যমে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে সশস্ত্র জিহাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ, পর্যাপ্ত সামর্থ্য, বৈধ কর্তৃপক্ষ এবং আল্লাহর পথে নির্দেশ দানকারী আমীরের প্রয়োজন হবে। নইলে ছবর করতে হবে এবং আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে (পৃঃ ২১-২৫)
  4. মুসলিমদের মধ্যে পরস্পরে যুদ্ধ নিষিদ্ধ (পৃঃ ২৫-২৭)
  5. জিহাদ ফরযে আয়েন হয় চারটি অবস্থায় : (১) মুসলমানদের বাড়ীতে বা শহরে শত্রুবাহিনী উপস্থিত হ’লে (২) শাসক যখন কাউকে যুদ্ধে বের হবার নির্দেশ দেন (৩) যুদ্ধের সারিতে উপস্থিত হ’লে এবং (৪) যখন কেউ বাধ্য হয় (পৃঃ ৩১)
  6. সুস্থ, বয়ঃপ্রাপ্ত ও জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম পুরুষের উপরে জিহাদ ফরয, যখন তার নিকটে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের বাইরে জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ, সুযোগ ও সামর্থ্য থাকবে (পৃঃ ৩৩)
  7. আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের পক্ষ হ’তে সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়মিত সেনাবাহিনী সরাসরি যুদ্ধের দায়িত্ব পালন করবে এবং অন্যেরা তাদের সহযোগিতা করবে। নিয়ত খালেছ থাকলে ও যুদ্ধ আল্লাহর জন্য হ’লে সকলেই তাতে জিহাদের পূর্ণ নেকী লাভে ধন্য হবেন ইনশাআল্লাহ। এমনকি জিহাদের জন্য অমুসলিমদের নিকট থেকেও সাহায্য গ্রহণ করা যাবে, যদি তাদের থেকে কোনরূপ ক্ষতির আশংকা না থাকে (পৃঃ ৩৬-৩৭)
  8. জিহাদের মাধ্যম ৪ টি : (১) অন্তর দিয়ে (২) যবান দিয়ে (৩) মাল দিয়ে এবং (৪) অস্ত্রের মাধ্যমে (পৃঃ ৩৭)
  9. জিহাদ ৩ প্রকার : (১) নফসের বিরুদ্ধে (২) শয়তানের বিরুদ্ধে (৩) কাফের-মুশরিক ও ফাসেক-মুনাফিকের বিরুদ্ধে (পৃঃ ৩৯-৪১)
  10. মুসলিম হৌক অমুসলিম হৌক প্রতিষ্ঠিত কোন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইসলামের নীতি নয়। তবে ইসলাম বিরোধী হুকুম মানতে কোন মুসলিম নাগরিক বাধ্য নয়। অতএব সর্বাবস্থায় তাওহীদের কালেমাকে সমুন্নত রাখা ও ইসলামী স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বৈধভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা করা মুসলমানের উপর ফরয দায়িত্ব। এমতক্ষেত্রে সরকারের নিকটে কুরআন ও হাদীছের বক্তব্য তুলে ধরাই বড় জিহাদ। যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয় (পৃঃ ৪২)
  11. প্রকাশ্য কুফরী : কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে যাচাই সাপেক্ষে সরকারের কুফরী সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে এবং বারবার বুঝানো সত্ত্বেও স্বীয় অবিশ্বাসে অটল থাকলে তাকে ‘প্রকাশ্য কুফরী’ হিসাবে গণ্য করা যাবে। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, কাফের সাব্যস্ত হ’লেই উক্ত শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরয। কারণ যুদ্ধ করার বিষয়টি শর্ত সাপেক্ষ (পৃঃ ৪৪-৪৫)
  12. মুসলিম সমাজে কারু মধ্যে ‘প্রকাশ্য কুফরী’ দেখা গেলে প্রথমে তাকে উপদেশের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও না পারলে ঐ ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলবে। সাথে সাথে তার হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করবে। যদি সরকার অমুসলিম হয় ও ইসলামে বাধা সৃষ্টি করে অথবা মুসলিম সরকারের মধ্যে ‘প্রকাশ্য কুফরী’ দেখা দেয় এবং ইসলামের সাথে দুশমনী করে, তাহলে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকলে বৈধ পন্থায় সেটা করবে। নইলে ছবর করবে এবং আমর বিন মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মূলনীতি অনুসরণে ইসলামের পক্ষে জনমত গঠন করবে। এটাই নবীগণের চিরন্তন তরীকা (পৃঃ ৪৮)
  13. কাফির গণ্য করার মূলনীতি সমূহ : (১) কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতেই এটা সাব্যস্ত হবে ব্যক্তির অবস্থা ভেদে। (২) কাউকে কাফের সাব্যস্ত করা যায় না তার অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে। (৩) কারু কথা, কাজ বা বিশ্বাসের ভিত্তিতেই কেবল তাকে কাফের বলা যাবে না। যতক্ষণ না তার কাছে দলীল স্পষ্ট করা হবে এবং সন্দেহ দূর করা হবে। (৪) ঈমানের একটি শাখা কোন ব্যক্তির মধ্যে থাকলেই তাকে ‘মুমিন’ বলা যায় না। তেমনি কুফরের কোন অংশ কারু মধ্যে থাকলেই তাকে ‘কাফের’ বলা যায় না। (৫) ইসলামের মূল বিষয়গুলি অস্বীকার করলে কাফের হবে, আর শাখাগুলি অস্বীকার করলে কাফের হবে না, এমনটি নয়। বরং শরী‘আতের প্রতিটি বিষয়ই পালনীয়। (৬) একই ব্যক্তির মধ্যে ঈমান ও কুফর, তাওহীদ ও শিরক, তাক্বওয়া ও পাপাচার, সরলতা ও কপটতা দু’টিই একত্রিত হ’তে পারে। আহলে সুন্নাতের নিকট এটি একটি বড় মূলনীতি। যা খারেজী, মুরজিয়া, মু‘তাযিলা, ক্বাদারিয়া ও অন্যান্য ভ্রান্ত ফের্কাসমূহের বিপরীত (পৃঃ ৪৯-৫০)
  14. মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পরস্পরে কাফের গণ্য করার ধারাবাহিক ইতিহাস (পৃঃ ৫১-৫৫)
  15. সরকারের সুস্পষ্ট কুফরী প্রমাণিত হলে তার আনুগত্যমুক্ত হওয়া যাবে। তবে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকলে বিদ্রোহ করা যাবে না। বরং ধৈর্যধারণ করতে হবে, যতক্ষণ না আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন ফায়ছালা নাযিল হয় (পৃঃ ৫৫)
  16. কারু বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার অধিকার হ’ল মুসলমানদের সর্বসম্মত আমীরের (নিসা ৪/৫৯)। অন্য কারু নয়। একইভাবে ইসলামী হুদূদ বা দন্ডবিধি সমূহ শাসক ব্যতীত অন্য কেউ প্রয়োগ করতে পারে না (পৃঃ ৫৭)
  17. অমুসলিম বা ফাসেক মুসলিম সরকার উভয়ের বিরুদ্ধে মুমিনের কর্তব্য হ’ল- (১) বৈধভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো। (২) দেশে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। (৩) বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করা। (৪) সরকারের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা। (৫) সরকারের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকটে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করা (পৃঃ ৬১)
  18. সূরা মায়েদাহ ৪৪ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অস্বীকার করল সে কুফরী করল। আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করল, কিন্তু সে অনুযায়ী বিচার বা শাসন করল না সে যালিম ও ফাসিক। তিনি বলেন, এটি ঐ কুফরী নয়, যা কোন মুসলিমকে ইসলামের গন্ডী থেকে বের করে দেয়। বরং এর দ্বারা বড় কুফরের নিম্নের কুফর বুঝানো হয়েছে’। যার ফলে সে কবীরা গোনাহগার হয়’ (পৃঃ ৬২)
  19. কুফর দু’প্রকার : (১) বিশ্বাসগত কুফরী, যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। (২) কর্মগত কুফরী, যা খারিজ করে দেয় না। তবে সে কবীরা গোনাহগার হয়, যা তওবা ব্যতীত মাফ হয় না। প্রথমটি বড় কুফর এবং দ্বিতীয়টি ছোট কুফর (পৃঃ ৭৫)
  20. দ্বীন ধ্বংস করে তিনজন : (১) অত্যাচারী শাসকবর্গ (২) স্বেচ্ছাচারী ধর্মনেতাগণ (৩) ছূফী ও দরবেশগণ (পৃঃ ৮৫)
  21. একমাত্র হকপন্থী দল হ’ল ‘আহলুল হাদীছ’। যারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী থাকবে। আর এ বিজয় অর্থ আখেরাতের বিজয় (পৃঃ ৮৫-৮৭)
  22. একজন মুমিন যেখানেই বসবাস করুক, সর্বদা তার জিহাদী চেতনা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। ‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ’-এর মূলনীতি থেকে সে মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকতে পারবে না। বাতিলের সঙ্গে আপোষ করে নয়, বরং বাতিলের মুকাবিলা করেই তাকে এগোতে হবে। এজন্য নিরন্তর দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে সংস্কার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এককভাবে ও সংগঠিতভাবে। এভাবেই সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আসবে ইনশাআল্লাহ (পৃঃ ৯০)

--০--

سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك، اللهم اغفرلى ولوالدىّ وللمؤمنين يوم يقوم الحساب-