জিহাদ ও কিতাল

ছোট কুফর (الكفر الأصغر)

যারা ঈমানের ছয়টি রুকন ও ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, ইসলামের সকল বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ বিশ্বাস পোষণ করে, হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম মনে করে। এতদসত্ত্বেও অজ্ঞতা, উদাসীনতা ও অলসতাবশে কিংবা পরিস্থিতির চাপে কোন কবীরা গোনাহ করে, সে ব্যক্তি কর্মগত কাফের বা ছোট কাফের হবে। সে মুসলিম উম্মাহ থেকে বহিষ্কৃত হবে না। যেমন-

(১) আল্লাহ বলেন, وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِيْنَ আর যদি মুমিনদের দু’দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহ’লে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর বাড়াবাড়ি করে, তাহলে যে দলটি বাড়াবাড়ি করবে, তার বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না সে দলটি আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি দলটি ফিরে আসে তাহলে তাদের মধ্যে ইনছাফের সাথে মীমাংসা কর এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালবাসেন’(হুজুরাত ৪৯/৯)

আয়াতটি নাযিল হয়েছিল মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলের সাথে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সাথী খাঁটি মুসলমানদের মধ্যে উভয়ের উপস্থিতিতে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া একটি লড়াইকে কেন্দ্র করে। যা রাসূল (ছাঃ)-এর দ্রুত হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়।[1] অত্র আয়াতে মুমিনদের মধ্যকার দু’দলের (مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ) মধ্যে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কাউকে আল্লাহ ‘কাফের’ আখ্যায়িত করেন নি। যেমন খারেজী, শী‘আ, মু‘তাযিলা ও তাদের অনুসারীরা সুন্নীদের প্রতি করে থাকে।

(২) قَالَتِ الْأَعْرَابُ آمَنَّا قُلْ لَمْ تُؤْمِنُوا وَلَكِنْ قُولُوا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الْإِيمَانُ فِي قُلُوْبِكُمْ وَإِنْ تُطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ لاَ يَلِتْكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ- ‘বেদুঈনরা বলে, আমরা ঈমান আনলাম। বল, তোমরা ঈমান আনোনি। বরং তোমরা বল, আমরা ইসলাম কবুল করলাম। এখনো পর্যন্ত তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, তাহ’লে তিনি তোমাদের আমলসমূহের কোন কিছুই হরাস করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (হুজুরাত ৪৯/১৪)। অত্র আয়াতে বেদুঈনদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি বলা হলেও তাদেরকে ইসলামের গন্ডি থেকে বহিষ্কৃত বলা হয় নি। কারণ আল্লাহ ও রাসূলের যথাযথ আনুগত্য না করাটা ছিল তাদের কর্মগত কুফরী; বিশ্বাসগত কুফরী নয়।

(৩) একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিচ্ছিলেন। এসময় তাঁর নাতি হাসান বিন আলী মিম্বরের উপরে ছিলেন। তিনি এসময় একবার ঐ বাচ্চার দিকে ও একবার উপস্থিত মুছল্লীদের দিকে তাকিয়ে বলেন, إِنَّ ابْنِى هَذَا سَيِّدٌ ، وَلَعَلَّ اللهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ ‘নিশ্চয়ই আমার এ বেটা হ’ল নেতা। ভবিষ্যতে আল্লাহ এর মাধ্যমে মুসলমানদের দু’টি বড় দলের মধ্যে সন্ধি করে দিবেন’।[2]

উল্লেখ্য যে, হযরত আলী (রাঃ) খারেজীদের হাতে নিহত হওয়ার পর পুত্র হাসান (রাঃ) খলীফা হন। অতঃপর যুদ্ধ পরিহার করে পাঁচ মাসের মধ্যে তিনি আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর অনুকূলে খেলাফত ত্যাগ করেন এবং ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যেকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নিরসন করেন। অত্র হাদীছে রাসূল (ছাঃ) আলী ও মু‘আবিয়া উভয়ের সমর্থক দু’টি বড় দলকে ‘মুসলিম’ বলে (فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ) অভিহিত করেছেন। কাউকে কাফের বলেননি। উল্লেখ্য যে, এ ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে তাঁর সত্যনবী হওয়ার অকাট্য প্রমাণ লুকিয়ে রয়েছে।

(৪) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং পরস্পরে যুদ্ধ করা কুফরী’।[3]

(৫) তিনি বলেন, إِثْنَتَانِ فِى النَّاسِ هُمَا بِهِمْ كُفْرٌ الطَّعْنُ فِى النَّسَبِ وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ দু’জন মানুষের মধ্যে কুফরী রয়েছে : অন্যের বংশ সম্পর্কে তাচ্ছিল্য করা এবং মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা’।[4]

(৬) مَنْ أَتَى كَاهِناً أَوْ عَرَّافاً فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ ‘যে ব্যক্তি গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে এলো এবং সে যা বলল তা বিশ্বাস করল, ঐ ব্যক্তি মুহাম্মাদ-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার সাথে কুফরী করল’।[5]

(৭) لاَ تَرْغَبُوا عَنْ آبَائِكُمْ ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ أَبِيهِ فَهُوَ كُفْرٌ ‘তোমরা তোমাদের বাপ-দাদা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। কেননা যে ব্যক্তি তার পিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, সে কুফরী করল’।[6]

(৮) مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللهِ فَقَدْ كَفَرَ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করল, সে কুফরী করল’।[7]

(৯) তিনি বলেন, ‘(মে‘রাজের সময়) আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়। সেখানে অধিকাংশকে আমি নারীদের মধ্য থেকে দেখেছি। জিজ্ঞেস করা হ’ল, তারা কি আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করেছে? জবাবে তিনি বললেন, তারা তাদের স্বামীদের সাথে কুফরী করেছে। তারা স্বামীদের অনুগ্রহকে অস্বীকার করে। তুমি তার সাথে বহুদিন যাবৎ ভাল ব্যবহার করলেও যখনই তোমার মধ্যে কিছু ত্রুটি দেখে তখনই তারা বলে, কখনো তোমার মধ্যে আমি ভাল কিছু দেখিনি।[8]

(১০) বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِى كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ আমার মৃত্যুর পরে  তোমরা একে অপরের গর্দান উড়িয়ে দিয়ে পুনরায় কাফের হয়ে যেয়ো না’।[9]

উপরের আয়াত ও হাদীছগুলি সব কর্মগত কুফরীর উদাহরণ। অতএব যদি কোন সরকার আক্বীদাগতভাবে ইসলামে বিশ্বাসী হয়, কিন্তু কর্মগতভাবে ইসলামের কোন বিধান লংঘন করে, তাহ’লে উক্ত সরকার কবীরা গোনাহগার হবে, কিন্তু কাফের হবে না। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, যদি সরকার ইসলামবিরোধী আইনে খুশী থাকে ও তাতে বিশ্বাসী হয়, তাহ’লে উক্ত কর্মগত কুফরী বিশ্বাসগত কুফরীতে পরিণত হয়ে যাবে এবং তারা তখন প্রকৃত কাফের হবে’।[10] একই হুকুম ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।


[1]. আহমাদ হা/১২৬২৮, বুখারী হা/২৬৯১, মুসলিম হা/১৭৯৯।

[2]. বুখারী হা/২৭০৪; মিশকাত হা/৬১৩৫।

[3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৮১৪।

[4]. মুসলিম হা/৬৭।

[5]. আহমাদ, ছহীহাহ হা/৩৩৮৭; মিশকাত হা/৫৫১।

[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৩১৫।

[7]. তিরমিযী হা/১৫৩৫, মিশকাত হা/৩৪১৯।

[8]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৮২, ‘চন্দ্র গ্রহণের ছালাত’ অনুচ্ছেদ।

[9]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৫৩৭ ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়, ৪ অনুচ্ছেদ।

[10]. মুহাম্মাদ বিন হুসায়েন আল-ক্বাহত্বানী, ফাতাওয়াল আয়েম্মাহ (রিয়াদ : ১৪২৪ হিঃ) ১৫৩ পৃঃ; ফিৎনাতুত তাকফীর ওয়াল হাকেমিয়াহ, পৃঃ ৩৫।