জিহাদ ও কিতাল

নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য

মুসলিম সরকারকে ‘কাফির’ বলা ছাড়াও এইসব মুফাসসিরগণ নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল ‘রাষ্ট্র কায়েম করা ও শাসনক্ষমতা দখল করা’ বলে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের অপব্যাখ্যা করেছেন। যেমন,

(ক) শূরা ১৩। আল্লাহ বলেন, شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسَى وَعِيْسَى أَنْ أَقِيْمُوا الدِّينَ وَلاَ تَتَفَرَّقُوا فِيْهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِيْنَ مَا تَدْعُوْهُمْ إِلَيْهِ اللهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيْبُ ‘তিনি তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন সেই দ্বীন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমরা প্রত্যাদেশ করেছি তোমার প্রতি ও যার আদেশ দিয়েছিলাম আমরা ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর ও তার মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। তুমি মুশরিকদের যে বিষয়ের দিকে আহবান কর, তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং তিনি পথ প্রদর্শন করেন ঐ ব্যক্তিকে, যে তাঁর দিকে প্রণত হয়’ (শূরা ৪২/১৩)

অত্র আয়াতে বর্ণিত ‘আক্বীমুদ্দীন’ (أَقِيْمُوا الدِّينَ) অর্থ ‘তোমরা তাওহীদ কায়েম কর’। নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলকে আল্লাহ একই নির্দেশ দিয়েছিলেন। সকল মুফাসসির এই অর্থই করেছেন। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولاً أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ ‘নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং ত্বাগূতকে বর্জন করো’ (নাহল ১৬/৩৬)। যার দ্বারা ‘তাওহীদে ইবাদত’ বুঝানো হয়েছে।

কিন্তু তারা অর্থ করেছেন ‘তোমরা হুকূমত কায়েম করো’। এর পক্ষে তারা একটি হাদীছেরও অপব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمُ الأَنْبِيَاءُ، كُلَّمَا هَلَكَ نَبِىٌّ خَلَفَهُ نَبِىٌّ  ‘নিশ্চয়ই বনু ইস্রাঈলকে পরিচালনা করতেন নবীগণ। যখন একজন নবী মারা যেতেন, তখন তার স্থলে আরেকজন নবী আসতেন’।[1]

এখানে تَسُوسُهُمُ الأَنْبِيَاءُ -এর অর্থ তারা করেছেন ‘নবীগণ বনু ইস্রাঈলদের মধ্যে রাজনীতি করতেন’। অর্থাৎ নবীগণ সবাই তাদের মত ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করেছেন। অতএব আমাদেরও সেটা করতে হবে। অথচ নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, وَمَا نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلاَّ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ فَمَنْ آمَنَ وَأَصْلَحَ فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ ‘আমরা নবীগণকে স্রেফ এজন্যই প্রেরণ করে থাকি যে, তারা (ঈমানদারগণকে জান্নাতের) সুসংবাদ দিবে ও (মুশরিকদের জাহান্নামের) ভয় প্রদর্শন করবে। অতএব যে ব্যক্তি ঈমান আনে ও নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না’ (আন‘আম ৬/৪৮)। অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তাকে বলতে বলেছেন, قُلْ لاَ أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا إِلاَّ مَا شَاءَ اللهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلاَّ نَذِيرٌ وَبَشِيْرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُوْنَ ‘তুমি বল, যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমি আমার নিজের কোন কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক নই। যদি আমি অদৃশ্যের খবর রাখতাম, তাহ’লে আমি অধিক কল্যাণ অর্জন করতাম এবং কোনরূপ অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করত না। আমি বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য একজন ভয় প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদ দানকারী মাত্র’ (আ‘রাফ ৭/১৮৮)। আর মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব হ’ল ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার’। অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা (আলে ইমরান ৩/১১০)। যা সর্বাবস্থায় মুমিন করবে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী। এজন্য তাকে ইসলামী রাজনীতির নামে পৃথকভাবে কোন রাজনীতি করার প্রয়োজন হবে না বা ক্ষমতা দখল করতে হবে না। আর আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার-এর উদ্দেশ্য হবে মানুষকে শিরকের কলুষ-কালিমা থেকে পবিত্র করে আল্লাহর অনুগত বানানোর চেষ্টা করা। যেমন আল্লাহ শেষনবীকে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ بَعَثَ فِيْهِمْ رَسُولاً مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُبِيْنٍ ‘বিশ্বাসীদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি তাদের নিকট তাদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনান ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত (কুরআন ও সুন্নাহ) শিক্ষা দেন। যদিও তারা ইতিপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে ছিল’(আলে ইমরান ৩/১৬৪; জুমু‘আহ ৬২/২)

এতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যুগে যুগে নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল আখেরাতভোলা মানুষকে আখেরাতে সাফল্য লাভের পথ দেখানো। তাদেরকে নেকীর কাজে উৎসাহিত করা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা। রাসূলগণ ক্ষমতার লোভে রাজনীতি করতে দুনিয়ায় আসেননি। বরং তাদের কাজই ছিল ‘তাবশীর ও ইনযার’ তথা জান্নাতের সুসংবাদ শুনানো ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করা। আর এজন্য তাঁদের কর্মপদ্ধতি ছিল ‘তারবিয়াহ ও তাযকিয়াহ’ অর্থাৎ পরিচর্যা করা ও পাপ থেকে পরিশুদ্ধ করা। আজও মুমিনের কর্মপদ্ধতি সেটাই থাকবে। আর এটাই হ’ল সর্বোত্তম পদ্ধতি। যা রাসূল (ছাঃ) প্রতি খুৎবাতে বলতেন, (وَخَيْرَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ) ‘শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদের হেদায়াত’।[2]

অথচ প্রতি খুৎবায় ও ভাষণে ইসলামী নেতারা এ হাদীছ পাঠ করা সত্ত্বেও তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর শ্রেষ্ঠ হেদায়াত বাদ দিয়ে ইহূদী-নাছারাদের প্রতারণাপূর্ণ তন্ত্র-মন্ত্রের অনুসারী হয়েছেন। আর তাকেই তাঁরা বলছেন ‘ইসলামী রাজনীতি’। এভাবে তাঁরা হারামকে হালাল করেছেন পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে। অথচ উচিৎ ছিল প্রচলিত বাতিল মতবাদসমূহের বিরুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া হেদায়াতকে প্রতিষ্ঠা দানের জন্য জান-মাল বাজি রেখে প্রচেষ্টা চালানো ও জনগণকে সেদিকে পথ দেখানো। নবীগণ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে দ্বীন কায়েম করেননি। বরং আল্লাহর পথে দাওয়াতের মাধ্যমেই দ্বীন কায়েমের কাজ শুরু করেছিলেন। আমাদেরকেও সেইভাবে কাজ করতে হবে। জনৈক দাঈ-র ভাষায়, أَقِيْمُوا دَوْلَةَ الْإِسْلاَمِ فِى قُلُوْبِكُمْ، تَقُمْ لَكُمْ عَلَى أَرْضِكُمْ ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ইসলাম কায়েম করো, তাহ’লে তোমাদের মাটিতে ইসলাম কায়েম হবে’। কেননা আক্বীদা পরিচ্ছন্ন না হ’লে কখনো আমল পরিচ্ছন্ন হবে না।

(খ) হাদীদ ২৫। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيْهِ بَأْسٌ شَدِيْدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ ‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণাদি সহকারে এবং তাদের সঙ্গে নাযিল করেছি কিতাব ও ন্যায়দন্ড। যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আর আমরা লৌহ নাযিল করেছি যার মধ্যে রয়েছে প্রচন্ড শক্তি ও রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। যাতে আল্লাহ জেনে নিতে পারেন কে তাকে ও তার রাসূলদেরকে না দেখেও সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা শক্তিমান ও পরাক্রমশালী’ (হাদীদ ৫৭/২৫)

খারেজীপন্থী মুফাসসিরগণ এখানে ‘লৌহ’ অর্থ করেছেন ‘Authority’ বা ‘শাসনশক্তি’। কেননা তাদের মতে ‘শাসনক্ষমতা প্রয়োগ ছাড়া মানবাধিকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়’। অথচ রাসূলগণ কেউই শাসনক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেননি। বরং তাঁরা হিকমত ও নছীহতের মাধ্যমেই সমাজ সংশোধন করেছেন। আবুবকর, ওমর, ওছমান, আলী, হামযা কেউই অস্ত্রের ভয়ে বা শাসনশক্তির ভয়ে মুসলমান হননি।

কুরআনের এইরূপ অপব্যাখ্যার কারণেই দেখা যায় এইসব চরমপন্থী ও ক্ষমতালোভী দলের লোকেরা সর্বত্র ক্ষমতা পাবার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। এমনকি মসজিদ-মাদরাসার কমিটি দখল এবং ইমাম-মুওয়াযযিন ও শিক্ষক নিয়োগেও তাদের অপতৎপরতা সকলের চোখে পড়ে। ছালাত-ছিয়ামের ফরয ইবাদতকেও এরা ‘মুবাহ’ বলে থাকে। যা আদায় করলে নেকী আছে, না করলে গোনাহ নেই। কারণ তাদের মতে ‘সব ফরযের বড় ফরয’ হ’ল শাসনক্ষমতা দখল করা। সেটা কায়েম না থাকায় তাদের মতে ‘কোন ফরযই বাস্তবে ফরযের পজিশনে নেই। বরং ‘মুবাহ’ অবস্থায় আছে’। তারা তাদের দলের বাইরে কাউকে উদারভাবে ভালবাসতে পারে না। এমনকি কারু সাথে সরল মনে সালাম-মুছাফাহা করতে পারে না। কারণ অন্যেরা তাদের দৃষ্টিতে হয় কাফির নয় ইহূদী। হা-শা ওয়া কাল্লা

বস্ত্ততঃ এই ধরনের খারেজী তাফসীর বহু যুবকের পথভ্রষ্টতার কারণ হয়েছে। তারা অবলীলাক্রমে মুসলিম সরকার ও সমাজকে কাফের ভাবছে ও তাদেরকে বোমা মেরে ধ্বংস করে দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, মুশরিকের আনুগত্য করলে মুমিন তখনই মুশরিক হবে, যখন বিশ্বাসগতভাবে সেটা করবে। কিন্তু যখন কর্মগতভাবে করবে, অথচ তার হৃদয় ঈমানে স্বচ্ছ থাকবে, তখন সে মুশরিক বা কাফির হবে না। বরং গোনাহগার হবে’।[3]

বস্ত্ততঃ অন্তর থেকে কালেমা শাহাদাত পাঠকারী কোন মুমিন কবীরা গোনাহের কারণে কাফের হয় না। এটিই হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের সর্বসম্মত আক্বীদা।


[1]. বুখারী হা/৩৪৫৫ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়, ৫০ অনুচ্ছেদ।

[2]. মুসলিম হা/৮৬৭; মিশকাত হা/১৪১।

[3]. কুরতুবী, আন‘আম ১২১ আয়াতের তাফসীর।-

قَالَ ابْنُ الْعَرَبِيِّ: إِنَّمَا يَكُونُ الْمُؤْمِنُ بِطَاعَةِ  الْمُشْرِكِ مُشْرِكًا إِذَا أَطَاعَهُ فِي الِاعْتِقَادِ، فَأَمَّا إِذَا أَطَاعَهُ فِي الْفِعْلِ وَعَقْدُهُ سَلِيمٌ مُسْتَمِرٌّ عَلَى التَّوْحِيدِ وَالتَّصْدِيقِ فَهُوَ عَاصٍ-