জিহাদ ও কিতাল

জিহাদের উদ্দেশ্য

(১) জিহাদ হবে আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য ও তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। যেমন আল্লাহ বলেন, وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا ‘তিনি স্বীয় রাসূলকে সাহায্য করেন এমন বাহিনী দ্বারা যাদেরকে তোমরা দেখোনি। তিনি কাফিরদের ঝান্ডাকে অবনমিত করেন ও আল্লাহর ঝান্ডাকে সমুন্নত করেন’ (তওবাহ ৯/৪০)

হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, কোন ব্যক্তি যুদ্ধ করে গণীমত লাভের জন্য, কেউ যুদ্ধ করে নাম-যশের জন্য, কেউ যুদ্ধ করে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য। এক্ষণে কোন্ ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে? জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةُ اللهِ هِىَ الْعُلْيَا فَهُوَ فِى سَبِيلِ اللهِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য লড়াই করে, সেই-ই মাত্র আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে’।[1] আল্লাহ বলেন,هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَكَفَى بِاللهِ شَهِيدًا- ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি স্বীয় রাসূলকে হেদায়াত ও সত্যদ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপরে তাকে বিজয়ী করতে পারেন। আর (এ ব্যাপারে) সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (ফাৎহ ৪৮/২৮)। অর্থাৎ ইসলাম যে সকল দ্বীনের উপরে বিজয়ী, সে বিষয়ে আল্লাহই বড় সাক্ষী। কারণ অন্যেরা তা স্বীকার করে না বা করবেও না। সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ  ‘যদিও মুশরিকরা তা অপসন্দ করে’ (তওবাহ ৯/৩৩, ছফ ৬১/৯)। তিনি বলেন, يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ ‘তারা আল্লাহর নূরকে (শরী‘আতকে) ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিতে চায়। অথচ আল্লাহ স্বীয় নূরকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন, যদিও কাফিররা তা অপসন্দ করে’ (ছফ ৬১/৮; তওবাহ ৯/৩২)

উপরোক্ত আয়াতসমূহে একথা পরিষ্কার যে, যারা ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনের সর্বত্র ইসলামী শরী‘আতকে কবুল করে না, বরং তাকে অপসন্দ করে, তারা কাফির ও মুশরিকদের অনুসারী এবং তারা ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দিতে চায়। যদিও তারা তাতে নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে।

(২) ইসলামে ‘জিহাদ’ স্রেফ আল্লাহর জন্য হয়ে থাকে, দুনিয়ার জন্য নয়। আল্লাহ বলেন, وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ  ‘তোমরা জিহাদ কর আল্লাহর পথে সত্যিকারের জিহাদ। তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন’ (হজ্জ ২২/৭৮)

(ক) ৭ম হিজরীতে খায়বর যুদ্ধে ইহূদীদের সবচাইতে মযবুত ‘নায়েম’ দুর্গ জয়ের পূর্বে ঝান্ডা হাতে দেওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেনাপতি আলী (রাঃ)-কে বলেন, যুদ্ধ শুরুর পূর্বে প্রতিপক্ষ যোদ্ধাদের প্রতি ইসলামের দাওয়াত দাও। কেননা فَوَاللهِ لَأَنْ يَّهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدًا خَيْرٌ لَّكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ ‘যদি তোমার দ্বারা আল্লাহ একজন ব্যক্তিকেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটি তোমার জন্য মূল্যবান লাল উটের (কুরবানীর) চাইতে উত্তম হবে’।[2]

এতে বুঝা যায় যে, স্রেফ যুদ্ধবিজয় ইসলামী জিহাদের লক্ষ্য নয়। বরং মানুষ আল্লাহর বিধানের অনুগত হৌক এটাই হ’ল কাম্য। যদি নিয়তের মধ্যে খুলূছিয়াত না থাকে, বরং ব্যক্তিস্বার্থ বা অন্য কোন দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিল করা উদ্দেশ্য হয়, তাহ’লে আল্লাহর দরবারে সেটা জিহাদ হিসাবে কবুল হবে না।

(খ) আল্লাহ বলেন, فَاعْبُدِ اللهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ ‘অতএব তুমি আল্লাহর ইবাদত কর তাঁর প্রতি খালেছ আনুগত্য সহকারে’ (যুমার ৩৯/২)। যুদ্ধাবস্থায় মৃত্যু হ’লেও ত্রুটিপূর্ণ নিয়তের কারণে ঐ ব্যক্তি শহীদের মর্যাদা হ’তে বঞ্চিত হবে। আবার শহীদ হওয়ার খালেছ নিয়তের কারণে বিছানায় মৃত্যুবরণ করেও অনেকে শহীদের মর্যাদা পাবেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে এবং হযরত আবুবকর (রাঃ), হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ) প্রমুখ। উক্ত মর্মে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। কেননা ‘নিয়ত’ হ’ল আমলের রূহ স্বরূপ। নিয়তহীন আমল লক্ষ্যহীন পথিকের ন্যায়। আল্লাহর কাছে ঐ আমলের কোন মূল্য নেই।

(গ) হযরত আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ আমল কবুল করেন না, যা তার জন্য খালেছ না হয় এবং যা স্রেফ তাঁর চেহারা অন্বেষণের লক্ষ্যে না হয়’।[3]

(ঘ) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ক্বিয়ামতের দিন প্রথম বিচার হবে (কপট) শহীদের। আল্লাহ তাকে (দুনিয়ায় প্রদত্ত) নে‘মত সমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন এবং সে তা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে বলা হবে, তুমি ঐসব নে‘মতের বিনিময়ে দুনিয়ায় কি কাজ করেছ? সে বলবে, আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য লড়াই করেছি ও অবশেষে শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এজন্য যুদ্ধ করেছিলে যেন তোমাকে ‘বীর’ (جَرِئٌ) বলা হয়। আর তা তোমাকে বলা হয়েছে। অতঃপর তার সম্পর্কে আদেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড়মুখী করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর আলেমদের, অতঃপর (লোক দেখানো) দানশীলদের একই অবস্থা হবে’।[4]

(ঙ) সাহল বিন হুনাইফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ سَأَلَ اللهَ الشَّهَادَةَ بِصِدْقٍ بَلَّغَهُ اللهُ مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে খালেছ অন্তরে শাহাদাত কামনা করে, আল্লাহ তাকে শহীদগণের স্তরে পৌঁছে দেন, যদিও সে বিছানায় মৃত্যুবরণ করে’।[5]

(চ) একদা এক খুৎবায় ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন, কেউ যুদ্ধে নিহত হ’লে বা মারা গেলে তোমরা বলে থাক যে, ‘অমুক লোক শহীদ হয়ে গেছে’। তোমরা এরূপ বলো না। বরং ঐরূপ বল যেরূপ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, مَنْ قُتِلَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ وَمَنْ مَاتَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হ’ল সে ব্যক্তি শহীদ এবং যে আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যু বরণ করল সে ব্যক্তি শহীদ’।[6]


[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৮১৪ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬০৮০; ফাৎহুল বারী হা/৪২১০।

[3]. আবুদাঊদ, নাসাঈ হা/৩১৪০।

[4]. মুসলিম হা/১৯০৫, মিশকাত হা/২০৫ ‘ইলম’ অধ্যায়।

[5]. মুসলিম হা/১৯০৯, মিশকাত হা/৩৮০৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[6]. আহমাদ হা/২৮৫, ১০৭৭২; ইবনু মাজাহ হা/২৯১০; মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১১।