জিহাদ ও কিতাল

জিহাদের প্রকারভেদ

(১) নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ : নফসের মধ্যে খারাপ চিন্তা আসাটা স্বাভাবিক। সেকারণ নফসকে কলুষিত করে ও আখেরাতের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে নেয় এমন সব সাহিত্য, পরিবেশ ও প্রচার মাধ্যম থেকে ও দুনিয়াবী জৌলুস থেকে নিজেকে সাধ্যমত দূরে সরিয়ে রাখতে হবে এবং সর্বদা দ্বীনী আলোচনা ও দ্বীনী পরিবেশের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখতে হবে। যেমন আল্লাহ তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন, وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلاَ تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلاَ تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا ‘তুমি নিজেকে ঐসব লোকদের সাথে ধরে রাখো, যারা তাদের প্রভুকে ডাকে সকালে ও সন্ধ্যায়। তারা কামনা করে কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। তুমি তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না। তুমি কি দুনিয়াবী জীবনের জৌলুস কামনা কর? তুমি ঐ ব্যক্তির অনুসরণ করো না, যার অন্তর আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল হয়েছে এবং সে প্রবৃত্তির অনুসারী হয়েছে ও তার কাজকর্মে সীমালংঘন এসে গেছে’ (কাহফ ১৮/২৮)

ফাযালাহ বিন ওবায়েদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِي اللهِ ‘মুজাহিদ সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে খুশী করার জন্য তার নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে’।[1] ছাহেবে তুহফাহ বলেন, এর অর্থ, যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে দমন করে এবং পাপ থেকে বিরত হয়ে আল্লাহ্র আনুগত্যে নিজেকে ধরে রাখে। আর এটাই হ’ল সকল জিহাদের মূল (وجهادها اصل كل جهاد)। কেননা যে ব্যক্তি নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারে না, সে ব্যক্তি বাইরে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারে না’।[2] বস্ত্ততঃ অর্থের লোভ, পদের লোভ, নাম-যশের লোভ প্রভৃতি মনের রোগ মানুষকে প্রতিনিয়ত আল্লাহ্র পথে জিহাদ থেকে ফিরিয়ে রাখে। তাই এই ভিতরকার গোপন শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথমে যুদ্ধ করা প্রয়োজন। এজন্যেই বলা হয়েছে,

أَشَدُّ الْجِهَادِ جِهَادُ الْهَوَى + وَمَا كَرَّمَ الْمَرْءَ اِلاَّ التُّقَى ‘সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ হ’ল প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর মানুষকে সম্মানিত করে না আল্লাহভীতি ব্যতীত’।

(২) শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ : শয়তান জিন ও ইনসান উভয়ের মধ্য থেকে হ’তে পারে (নাস ১১৪/৬)। এদের দিনরাতের কাজ হ’ল বিভিন্ন ধোঁকার মাধ্যমে মুমিনকে পথভ্রষ্ট করা। আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا ‘এমনিভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য শত্রু নিযুক্ত করেছি মানুষ ও জিন থেকে একদল শয়তানকে। যারা ধোঁকা দেওয়ার জন্য একে অপরকে কারুকার্য খচিত কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১২)। এদের থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ ‘যখন তুমি ঐসব লোকদের দেখবে যে, আমার আয়াত সমূহে ছিদ্রান্বেষণে লিপ্ত হয়েছে, তখন তুমি তাদেরকে এড়িয়ে চলো, যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়’ (আন‘আম ৬/৬৮)

এযুগে শয়তানের সবচেয়ে বড় ধোঁকা হ’ল গণতন্ত্র ও জঙ্গীবাদ। ক্ষমতা দখলের সুড়সুড়ি দিয়ে এ দু’টি মতবাদ মুসলিম সমাজকে পরস্পরে হানাহানি ও রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করেছে। তাদের নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতি শেষ করে দিয়েছে এবং তাদের ইহকাল ও পরকাল ধ্বংস করেছে। 

এজন্য শয়তানের অনুসারী ব্যক্তি ও সংগঠন বর্জন করা ও তাদের থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। শিরক ও বিদ‘আতপন্থী এবং ভোগবাদী ও বস্ত্তবাদী শিক্ষা ও পরিবেশ বর্জন করা যরূরী। সাথে সাথে এসবের অনুসারী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া থেকে নিজেকে ও নিজের গৃহকে পরিচ্ছন্ন রাখা অপরিহার্য। এসবের স্থলে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছপন্থী ব্যক্তি ও সংগঠনভুক্ত থাকা, দ্বীনী শিক্ষা ও পরিবেশ অপরিহার্য করে নেওয়া এবং এর অনুসারী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেকে ও নিজের গৃহকে আলোকিত রাখা আবশ্যক।

(৩) কাফির-মুশরিক ও ফাসিক-মুনাফিকের বিরুদ্ধে জিহাদ : আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ ‘হে নবী! তুমি জিহাদ কর কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে এবং তাদের উপরে কঠোর হও। ওদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর কতইনা মন্দ ঠিকানা সেটি’ (তওবা ৯/৭৩; তাহরীম ৬৬/৯)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে অস্ত্রের দ্বারা এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে যবান দ্বারা এবং অন্যান্য পন্থায় কঠোরতা অবলম্বনের দ্বারা’। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে সকল নষ্টের মূল জেনেও রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেননি তার বাহ্যিক ইসলামের কারণে। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর হাত দ্বারা, না পারলে যবান দ্বারা, না পারলে ওদেরকে এড়িয়ে চল’। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, যবান দ্বারা দলীল কায়েম করার বিষয়টি হ’ল স্থায়ী জিহাদ’।[3] আধুনিক যুগে যবান, কলম ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যম একই গুরুত্ব বহন করে। বরং কলমই হ’ল স্থায়ী জিহাদ।


[1]. তিরমিযী হা/১৬২১।

[2]. তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ তিরমিযী, হা/১৬৭১-এর ব্যাখ্যা।

[3]. কুরতুবী, সূরা তওবা ৭৩ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য; ৮/১৮৭ পৃঃ।