জীবন দর্শন

রাজনৈতিক দর্শন[1]

রাজা যে নীতির ভিত্তিতে রাজ্য চালান, তাকে রাজনীতি বলা হয়। বিগত দিনে অনেক রাজা অত্যাচারী ছিলেন বিধায় এখন আর কেউ ‘রাজা’ কথাটা মুখে আনেন না। কিন্তু ‘রাজনীতি’ পরিভাষাটা কেউ ছাড়তে চান না। পরিভাষা যেটাই হৌক না কেন রাজনীতির মূল দর্শন হ’ল সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। সেটা কী হবে? এ বিষয়ে পৃথিবীতে সর্বযুগে দু’টি দর্শনের সংঘাত চলে আসছে। এক- সমাজভুক্ত লোকদের মতি-মর্যী অনুযায়ী সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। একে বলে জাতীয়তাবাদী সমাজ বা রাষ্ট্র দর্শন। এইরূপ সমাজ বা রাষ্ট্রে সাধারণতঃ শক্তিশালী দল, শ্রেণী বা ব্যক্তির স্বৈরাচারী শাসন কায়েম হয়। কখনো ব্যক্তির নামে, কখনো জনগণের নামে এই লোকগুলিই হয় সার্বভৌম ক্ষমতার দাবীদার। নেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই এখানে নীতি হিসাবে গণ্য হয়, যা সর্বদা পরিবর্তনশীল। এই সমাজের রাজনীতি নিকৃষ্ট পর্যায়ের হয়ে থাকে। শাসকদলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ও শাসনযন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মূর্তিমান শোষক ও জাল্লাদের রূপ ধারণ করে ও পুরা সমাজকে নরকে পরিণত করে। নেতা অনেক সময় এটা না চাইলেও তার করণীয় কিছুই থাকে না। কারণ দলের নেতা-কর্মীরা নাখোশ হ’লে দল টিকবে না, নেতাও টিকবেন না। নামে-বেনামে পৃথিবীতে যুগে যুগে এই ধরনের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা চলে আসছে। মযলূম ও দুর্বল শ্রেণীর মানুষ কখনোই এ নীতি সমর্থন করে না। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা এই যে, দুর্বল শ্রেণীর লোকদের সাহায্যে ও সমর্থনেই এক শ্রেণীর লোক ক্ষমতা দখল করে এবং এদের উপরে যুলুম করে থাকে। যা আজও চলছে দোর্দন্ড প্রতাপে নানা চটকদার নাম ও আকর্ষণীয় মোড়কের আড়ালে মুখ লুকিয়ে।

দুই- আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। এই সমাজে শাসক-শাসিত সকলেই হয় আল্লাহর গোলাম। আর তাঁর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষ হয় সমান। এখানে নেতা বা শাসক কেবল আল্লাহর বিধানের প্রয়োগকারী হয়ে থাকেন। জনগণ আল্লাহর বিধান সমূহকে হাসিমুখে বরণ করে নেয় দুনিয়াবী কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির স্বার্থে। আল্লাহর দেওয়া আলো-বাতাস যেমন সবার প্রতি সমভাবে কল্যাণময় এবং অপরিবর্তনীয়, তেমনি আল্লাহর দেওয়া বিধানসমূহ হয় সকলের জন্য সমানভাবে কল্যাণময় এবং অপরিবর্তনীয়। এই রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হন ‘আল্লাহ’। আমীর বা খলীফা হন আল্লাহর প্রতিনিধি ও জনগণের প্রতিনিধি। আমীর কোন অবস্থাতেই আল্লাহর বিধানকে এড়িয়ে যেতে পারেন না বা কোনরূপ পরিবর্তন-পরিবর্ধন বা সংযোজন-বিয়োজন করতে পারেন না। তিনি তাঁর নিয়োজিত পার্লামেন্ট ও বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শে শাসনকার্য পরিচালনা করেন, যারা সর্বদা আল্লাহর বিধানের দাসত্ব করেন ও তাঁর বিধানের অনুকূলে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তার বাইরে যেতে পারেন না। কেননা আল্লাহর বিধানের বাইরে গেলেই তারা শয়তানের ফাঁদে আটকে যাবেন ও তাতে জনগণের ও সমাজের সমূহ ক্ষতি ও অকল্যাণ হবে। এমনকি বিশ্ব প্রকৃতিতেও তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। আসমানী ও যমীনী গযব সমূহ নেমে আসবে। সাধারণ জনগণ সর্বদা আল্লাহ প্রেরিত ন্যায়ানুগ শাসন কামনা করেন। কিন্তু শয়তানের দাসত্বকারী কিছু মানুষ সর্বদা যুলুম, প্রলোভন ও প্রতারণার মাধ্যমে তাদেরকে বশীভূত করে নিজেদের শাসন ও শোষণ চালিয়ে থাকেন।

যুগে যুগে নবীগণ মানুষকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন ও সমাজ গড়ার আহবান জানিয়ে গেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট রাসূল পাঠিয়েছি এই আহবান নিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর এবং ত্বাগূত (শয়তান) হ’তে দূরে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)। কোন কোন নবী স্বয়ং রাষ্ট্রনেতা হিসাবে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী দেশ শাসন করেছেন। সে সময় পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস বয়ে গেছে। সমাজ চিরদিন তাঁদের স্মরণ করে থাকে। এভাবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে কেবলমাত্র আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করাকেই বলা হয় ‘তাওহীদে ইবাদত’। এদিকেই শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ক্ষমতাগর্বী কুরায়েশ নেতাদের প্রতি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা বল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (‘নেই কেউ প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ ব্যতীত’), তাহ’লেই তোমরা সফলকাম হবে’। এযুগেও আমাদের আহবান হ’ল ‘সকল বিধান বাতিল কর, অহি-র বিধান কায়েম কর’- তাহ’লেই হে পৃথিবীর মানুষ! তোমরা সফলকাম হবে’। নতুবা যুগে যুগে কেবল নেতার বদল হবে, কিন্তু মানুষের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না। বরং দিন দিন অবনতি হবে।

প্রশ্ন হ’ল, সমাজে প্রচলিত জাহেলী বিধানের সাথে আপোষ করে কি আল্লাহর বিধান কায়েম করা সম্ভব? ত্বাগূতকে অস্বীকার করা ব্যতীত কি তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? নবীগণ কি শিরকের সাথে আপোষ করে দ্বীন কায়েম করেছিলেন? কখনোই নয়। তাঁরা একা থেকেছেন। বছরের পর বছর সীমাহীন বাধা, অপবাদ ও অত্যাচারের তীব্র কষাঘাত সহ্য করেছেন। অনেকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি যালেমদের হাতে জীবন দিয়েছেন। তথাপি বাতিলের সাথে আপোষ করেননি। আজও যদি কেউ সমাজ পরিবর্তনে আকাংখী হন ও তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন, তাহ’লে অবশ্যই তাকে আপোষহীনভাবে নবীগণের তরীকায় দাওয়াত ও সমাজ সংস্কারের কাজ করে যেতে হবে। আল্লাহ তাঁর প্রেরিত কিতাব ও দ্বীনকে অবশ্যই হেফাযত করবেন। আমাদের দায়িত্ব কেবল তাঁর দেখানো পথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ হ’ল মানবকল্যাণের সর্বাপেক্ষা বড় উৎস। এ দুই উৎসের আলোকধারায় চলার প্রতিজ্ঞা নিয়েই মানবজাতিকে তার জীবনপথ পাড়ি দিতে হবে। এপথে যিনি যতটুকু করবেন, ততটুকু প্রতিদান পাবেন। কিন্তু এর বাইরে পা ফেললেই তাকে শয়তানের বিছানো জালে জড়িয়ে যেতে হবে। যেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোন পথ হয়ত আর কখনোই সে পাবে না আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ব্যতীত।

আল্লাহর বিধান কায়েম হবে জন-ইচ্ছার উপরে ভিত্তি করে, অন্য কোনভাবে নয়। আর সেকারণ নবীগণ সর্বদা জনগণের কাছে গিয়েছেন। তাদেরকে বুঝিয়েছেন, ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন, সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেছেন। এভাবে ব্যক্তি জীবন আল্লাহর দাসত্বে অভ্যস্ত হ’লে রাষ্ট্রীয় জীবনে আল্লাহর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্ব কায়েম হবে ইনশাআল্লাহ। জনগণ স্বেচ্ছায় তা কবুল করবে। কোনরূপ প্রলোভন বা যবরদস্তির প্রয়োজন হবে না। অথচ করুণ বাস্তবতা এই যে, এদেশের শিক্ষিত সমাজের অধিকাংশ আজ পর্যন্ত জানেন না তাওহীদ কী? আল্লাহর দাসত্বের সারবত্তা কি? আল্লাহর বিধান সমূহ কি? তাতে দুনিয়া ও আখেরাতে লাভ কী? তাদের অনেকে ছালাত-যাকাত-ছিয়াম-হজ্জ ইত্যাদি পালন করেন। অনেকে এসব ইবাদতকে স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা মনে করেন কিংবা দলীয় সমর্থন আদায়ের কৌশল মনে করেন। এমতাবস্থায় সাধারণ লোকদের অবস্থা কী, তা অাঁচ করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

অতএব দ্বীন কায়েমের সুন্দর আকাংখাই যথেষ্ট নয়, বরং আকাংখা বাস্তবায়নে নবীগণের তরীকার অনুসারী হওয়া আবশ্যক। নবীগণ ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে দ্বীনের দাওয়াত দেননি। বরং শাসক-শাসিত নির্বিশেষে সকল মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া এবং তাঁর দাসত্বে ফিরিয়ে আনাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। হেদায়াত পাওয়া ও শাসনক্ষমতা লাভের বিষয়টি কেবলমাত্র আল্লাহর হাতেই নিবদ্ধ। দাওয়াত দেওয়া ফরয। দাওয়াতকে বিজয়ী করা ফরয নয়। কেননা সে দায়িত্ব আল্লাহর।

পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে মুসলিমদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে আল্লাহর পথে আদেশ ও শয়তানের পথ থেকে নিষেধ করার জন্য (আলে ইমরান ৩/১১০)। তাদের আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের দর্শন হ’ল ‘তাওহীদে ইবাদত’-এর দর্শন। অর্থাৎ সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব করা এবং সর্বক্ষেত্রে তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা। অতএব প্রচলিত শিরকী রাজনীতির বদ্ধ জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর দাসত্ব বরণের মধ্যেই কেবল মানুষের প্রকৃত কল্যাণ ও মুক্তি নিহিত রয়েছে। সমাজের কল্যাণকামী দূরদর্শী রাজনীতিকদের আমরা সেদিকেই আহবান জানাই।



[1]. আত-তাহরীক ১২তম বর্ষ ১২তম সংখ্যা সেপ্টেম্বর ২০০৯।