জীবন দর্শন

অর্থনৈতিক দর্শন[1]

মানুষ যে নীতির ভিত্তিতে তার আয়-ব্যয় পরিচালনা করে তাকে ‘অর্থনীতি’ বলা হয়। পৃথিবীতে মনুষ্য বসতির পর থেকেই মানব সমাজে পারস্পরিক অর্থনৈতিক লেনদেন চলে আসছে। অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের ন্যায় অর্থনীতির ক্ষেত্রেও মানুষের মধ্যে সর্বযুগে দু’টি দর্শনের সংঘাত চলে আসছে। এক- অবাধ ব্যক্তি মালিকানা ও সীমাহীন ভোগের অধিকার। আর এটা হ’ল মানুষের স্বভাবজাত মন্দ প্রবণতা। দুই- সম্পদে আল্লাহর মালিকানা স্বীকার করা ও তাঁর প্রদত্ত হালাল-হারামের বিধান মেনে চলা। এতে ব্যক্তির আয়-উপার্জনে সমাজের অধিকার স্বীকৃত হয় এবং সমাজের সবল-দুর্বল সকলের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন ও সরবরাহ নিশ্চিত হয়। প্রথমোক্ত অর্থনীতিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি বলা হয়। সেযুগে ফেরাঊনী রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেভাবে ক্বারূনী অর্থনীতিকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দুর্বল শ্রেণীর রক্ত শোষণ করত। এযুগে তেমনি কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি স্ব স্ব দেশের পুঁজিপতি ও ধনিক শ্রেণীকে সর্বতোভাবে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দুর্বল শ্রেণীর রক্ত শোষণ করে থাকে। শ্রমিকদের উঁচু-নীচু অবস্থার দিকে তাকালেই এটা পরিষ্কার বুঝা যাবে। ভোগের যথেচ্ছ অধিকার ও নিরংকুশ মালিকানা লাভের উদগ্র লালসা সমাজে হিংসা-হানাহানি, রক্তপাত, জিঘাংসা ও সংঘাতকে অনিবার্য করে তোলে। বর্তমানে কেবল নাম ও ধরনের পার্থক্য হয়েছে, চরিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি।

মাঝখানে খৃষ্টীয় ঊনবিংশ শতকে হেগেল, মার্কস ও এঙ্গেলসের উদ্ভাবিত পথে শ্রেণী সংগ্রামের নামে ধনীদের বিরুদ্ধে গরীবদের একটা সংঘবদ্ধ ও নিষ্ঠুর আন্দোলন গড়ে ওঠে। যাতে উভয়পক্ষে কয়েক কোটি মানুষের জান-মাল ও ইযযতের বিনিময়ে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ্বে রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ কায়েম হয়। অবাধ ব্যক্তি পুঁজিবাদে অনেক সময় পুঁজিপতি ও শিল্পপতিগণ তাদের শ্রমিকদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে থাকেন। কিন্তু ‘সর্বহারাদের স্বর্গ’ নামে কথিত কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রগুলিতে শ্রমিকদের এই সামান্য দয়া পাওয়ারও সুযোগ নেই রাষ্ট্রীয় আইনের বাঙ্ময় নিষ্পেষণের কারণে। এখানে অর্থনৈতিক শক্তির সাথে রাজনৈতিক শক্তি একীভূত হওয়ায় এর শোষণটা হয় যেমন সর্বাত্মক, তেমনি নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক। অবাধ ব্যক্তি পুঁজিবাদে বিভিন্ন জনের কাছে পুঁজি জমা হয়। যার ফলে সমাজদেহের রক্ত বিভিন্ন স্থানে ব্লক্ড হয়ে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। যা সমাজে অস্বাভাবিক ধন বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং এক সময় সমাজকে মৃতপ্রায় করে দেয়। পক্ষান্তরে কম্যুনিষ্ট সমাজে সকল পুঁজি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয় এবং রাষ্ট্রের নামে কতিপয় পার্টি লীডারের হাতে মানুষকে যিম্মী হ’তে হয়। এভাবে দেহের সকল রক্ত মাথায় জমা হয়ে যায়। ফলে দেহ রক্তশূন্য হয়ে এক সময় মারা পড়ে। মানুষ গোয়ালের গরু-ছাগলের মত কিংবা জেলখানার হাজতী-কয়েদীর মত রাষ্ট্রের দেওয়া খাদ্য-পানীয়ের মুখাপেক্ষী হয়। তার নিজস্ব আবেগ-অনুভূতি বা মেধা ও যোগ্যতার কোন মূল্যায়ন সেখানে থাকে না। From each according to his labour. To each according to his need. ‘প্রত্যেকের কাছ থেকে নেওয়া হবে তার শ্রম এবং দেওয়া হবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী’- এই নীতির ভিত্তিতে কথিত সাম্যবাদী অর্থনীতি পরিচালিত হয় বলে দাবী করা হয়। ফলে যে ব্যক্তি শ্রম দেওয়ার যোগ্যতা রাখে না, অথবা যে ব্যক্তি অন্যের চাইতে অধিক শ্রম দেয় কিংবা অধিক মেধা ও যোগ্যতার অধিকারী, তার যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। এ কারণে বহু ঢাক-ঢোল পিটানো বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম পঞ্চাশ বছরও টিকে থাকতে পারল না। বিপুল বেগে তারা ফিরে গেছে ফেলে আসা পুঁজিবাদের দিকে। এখন রাশিয়া ও চীনের পুঁজিপতিরা আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের পুঁজিপতিদের সাথে পাল্লা দিচ্ছে। যদিও তারা মুখে সমাজতন্ত্রের নাম নিচ্ছে কঠোরতম একদলীয় স্বৈরতন্ত্র টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। ফলকথা এই যে, অবাধ ব্যক্তি পুঁজিবাদ ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ দু’টিই চরমপন্থী মতবাদ এবং দু’টিই মানুষের স্বভাবধর্মের ঘোর বিরোধী।

উপরোক্ত দু’ধরনের পুঁজিবাদের বিপরীতে আল্লাহ প্রদত্ত অর্থনীতি হ’ল শরী‘আহ নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি মালিকানাধীন সামাজিক ন্যায়বিচারপূর্ণ অর্থনীতি। এখানে সম্পদের প্রকৃত মালিক ব্যক্তি বা রাষ্ট্র নয়, বরং আল্লাহ। এখানে ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত। যাতে সে তার নিজস্ব মেধা ও যোগ্যতাকে সাধ্য অনুযায়ী কাজে লাগাতে উৎসাহিত হয়। তবে সে আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধান মতে আয় ও ব্যয় করবে। এখানে তার কোনরূপ স্বেচ্ছাচারিতা চলবে না। এখানে সমাজকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি নয়, আবার ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে সমাজ নয়। উভয়ে উভয়ের মুখাপেক্ষী। ধনীকে তার উদ্বৃত্ত ধন গরীবকে দিতেই হবে। এটা গরীবের প্রতি করুণা নয়, বরং ধনীর সম্পদে গরীবের হক ও সুস্পষ্ট অধিকার (মা‘আরেজ ৭০/২৪)। গরীবকেও তেমনি ধনীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। কারণ তার মধ্যে অনুরূপ মেধা ও যোগ্যতা নেই। শিল্পপতি তার পুঁজি বিনিয়োগ করবে। কিন্তু কারখানা চালাবে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। উভয়কে উভয়ের স্বার্থ দেখতেই হবে আল্লাহর দেওয়া ন্যায়বিধান অনুসরণে, ক্বারূনী দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। শ্রমিকরা কেবল বেতনভুক শ্রমিক হবে না, তারাও কারখানার মালিকানার অংশীদার হবে। মালিক পুঁজি বিনিয়োগ করে যেমন মালিকানার দাবীদার হয়েছেন, শ্রমিক তার শ্রম বিনিয়োগ করে তেমনি তুলনামূলক মালিকানা লাভ করবে। লাভ ও লোকসানের ঝুঁকি মালিক ও শ্রমিক উভয়ে নেবে। এতে কারখানার উন্নতির প্রতি উভয়ের লক্ষ্য ও তদারকি থাকবে নিজের সম্পত্তির মতো। উভয়ের আন্তরিক সহযোগিতায় শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসায়-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। সর্বত্র অর্থের সরবরাহ বাড়বে। সমাজদেহের সর্বত্র রক্ত চলাচল করবে। সুস্থ প্রতিযোগিতায় সমাজে সচ্ছলতার আনন্দ বয়ে যাবে। শ্রমিক অসন্তোষ বলে কিছুই থাকবে না ইনশাআল্লাহ।

ইসলামী অর্থনীতিতে আখেরাতমুখী নৈতিকতাই প্রধান। এখানে ধনী-গরীবের বৈষম্যকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সহযোগিতা ও সহমর্মিতাকে অগ্রগণ্য রাখা হয়। ধনীর সম্পদে গরীবের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। ধনীকে তার উদ্বৃত্ত অর্থ গরীবকে দান করতে হয় (বাক্বারাহ ২/২১৯)। ভোগে নয়, ত্যাগেই এখানে আনন্দ। এটা আল্লাহকে দেওয়া ঋণ। এই ঋণ তার পরকালের আমলনামায় অফুরন্ত প্রবৃদ্ধির সাথে সঞ্চিত হয় (বাক্বারাহ ২/২৪৫)। যার মালিক সে কেবল একাই হবে। সেখানে কোন উত্তরাধিকারী থাকবে না। আল্লাহর দেওয়া সূর্য্যের কিরণ, চন্দ্রের আলো, বৃষ্টির পানি ভোগের অধিকার ধনী-গরীব সকলের জন্য সমান। কিন্তু ব্যক্তিগত মেধা ও যোগ্যতার পার্থক্য জন্মগতভাবেই আল্লাহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যাতে মানুষ একে অপরের কাছ থেকে কাজ নিতে পারে এবং পরস্পরের মুখাপেক্ষী থাকে ও আল্লাহর প্রতি অনুগত থাকে। এই পার্থক্য ও বৈষম্যকে অস্বীকার করা যেমন হঠকারিতা, একাই সবকিছু ভোগের অধিকার দাবী করাও তেমনি হঠকারিতা। ধনের নেশায় মত্ত ও সম্পদের অহংকারে স্ফীত মালিক যখন গাড়ী হাঁকিয়ে বাড়ী থেকে বের হন, তখন তিনি তার গরীব ড্রাইভারের মুখাপেক্ষী থাকেন। যখন ঐ মালিক রোগী হয়ে হাসপাতালে নীত হন, তখন ডাক্তার ও নার্সের মুখাপেক্ষী হন। অতএব তাকে অন্যের স্বার্থ দেখতেই হবে তার নিজের স্বার্থেই। যদি সবাই সমান অর্থ-সম্পদ এবং মেধা ও যোগ্যতার অধিকারী হ’ত, তাহ’লে দুনিয়া অচল হয়ে যেত। মানুষ তার প্রয়োজন পূরণে কারুরই কোন সাহায্য পেত না। শিল্পপতি তার কারখানায় শ্রমিক পেত না। কৃষক তার জমিতে মজুর পেত না। অতএব হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান করার অর্থনৈতিক ধ্যান-ধারণা কেবল রঙিন ও কষ্ট কল্পনা মাত্র। কথিত সাম্যবাদ বা কম্যুনিজম এখানেই ব্যর্থ হয়েছে।

আল্লাহ বলেন, ‘...আমরা তাদের জীবিকা বণ্টন করেছি পার্থিব জীবনে এবং একে অপরের উপর তাদের মর্যাদাকে উন্নীত করেছি, যাতে তারা একে অপর থেকে কাজ নিতে পারে’... (যুখরুফ ৪৩/৩২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা ধনীদের কাছ থেকে নাও ও গরীবদের মাঝে তা ফিরিয়ে দাও’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৭২)। তিনি বলেন, ‘তোমরা আমাকে তোমাদের দুর্বলদের মধ্যে সন্ধান কর। কেননা তোমরা রূযীপ্রাপ্ত হয়ে থাক এবং সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাক তোমাদের দুর্বলদের মাধ্যমে’ (আবুদাঊদ হা/২৫৯৪)। তিনি বলেন, ‘দরিদ্রগণ ধনীদের পাঁচশত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ (তিরমিযী হা/২৩৫৪)। ধনী ও গরীবের মধ্যে সহনশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা নিজেদের অপেক্ষা নিম্ন অবস্থার লোকদের দিকে তাকাও। এমন ব্যক্তির দিকে তাকিয়ো না, যে তোমাদের চাইতে উঁচু পর্যায়ের। যদি এই নীতি মেনে চলো, তাহ’লে তোমাকে দেওয়া আল্লাহর নে‘মত সমূহকে তুমি ক্ষুদ্র বা হীন মনে করবে না’ (মুসলিম হা/২৯৬৩)। বস্ত্ততঃ এর মধ্যেই রয়েছে শান্তি ও সুখের চাবিকাঠি। কেননা এর মাধ্যমে মানুষ নিজের প্রাপ্ত নে‘মতকে অনেকের চাইতে অধিক দেখতে পাবে। এতে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে। পক্ষান্তরে উঁচু পর্যায়ের লোকদের দেখে নিজের মধ্যে যে ক্ষোভ ও হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়, সেটাও দূরীভূত হবে। ইসলামী অর্থনীতি এভাবেই সমাজে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও শান্তি কায়েম করে। আর এটাই বাস্তব কথা যে, রুটির অভাব দারিদ্রে্যর একমাত্র প্রমাণ নয়, বরং পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহমর্মিতার অভাবই সমাজে দরিদ্রতার মূল কারণ।

পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী অর্থনীতির মূল ভিত্তি হ’ল সূদ। যা শোষণের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার এবং যার শেষ পরিণতি হ’ল নিঃস্বতা (ইবনু মাজাহ হা/২২৭৯)। পুঁজিবাদী ব্যক্তি ও রাষ্ট্র এক সময় নিঃস্ব ও দেউলিয়া হবেই। পৃথিবীর বিগত সকল ধর্ম এবং প্লেটো, এরিষ্টটল সহ ইসলাম-পূর্ব যুগের সকল মানবতাবাদী ব্যক্তিবর্গ সূদের বিরুদ্ধে সাবধান করে গেছেন। অতএব সূদী শোষণে নিষ্পিষ্ট মানবতাকে আজ ফিরে আসতে হবে ইসলামী অর্থনীতির দিকে, ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ বিনির্মানের পথে। আয় ও ব্যয়ের সকল ক্ষেত্রে শয়তানের দাসত্ব ছেড়ে আল্লাহর দাসত্বের পথে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে ‘তাওহীদে ইবাদত’ কায়েমের শপথ নিয়ে। এটাই হ’ল ইসলামের অর্থনৈতিক দর্শন। প্রকৃত মানবতাবাদী বিশ্বদর্শন। এর মধ্যেই রয়েছে ধনী ও গরীব সকল মানুষের প্রকৃত মুক্তি ও কল্যাণ। সমাজের মঙ্গলকামী দূরদর্শী রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদগণকে আমরা সেদিকেই আহবান জানাই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!



[1]. আত-তাহরীক ১৩তম বর্ষ ১ম সংখ্যা অক্টোবর ২০০৯।