যে সকল হারামকে মানুষ হালকা মনে করে

ভূমিকা

আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের উপরে কিছু জিনিস ফরয করেছেন, যা পরিত্যাগ করা জায়েয নয়, কিছু সীমা বেঁধে দিয়েছেন, যা অতিক্রম করা বৈধ নয় এবং কিছু জিনিস হারাম করেছেন, যার ধারে কাছে যাওয়াও ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন-

مَا أَحَلَّ اللهُ فِىْ كِتَابِهِ فَهُوَ حَلاَلٌ وَمَا حَرَّمَ فَهُوَ حَرَامٌ وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَافِيَةٌ فَاقْبَلُوْا مِنَ اللهِ الْعَافِيَةَ، فَإِنَّ اللهَ لَمْ يَكُنْ نَسِيًّا. ثُمَّ تَلاَ هَذِهِ الآيَةَ (وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا)-

‘আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে যা হালাল করেছেন তা হালাল, যা হারাম করেছেন তা হারাম, আর যে বিষয়ে তিনি নীরব থেকেছেন তা ক্ষমা। সুতরাং তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমাকে গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বিস্মৃত হন না। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন, ‘তোমার প্রতিপালক বিস্মৃত হন না’ (মারিয়াম ১৯/৬৪)।[1]

আর এই হারাম সমূহই আল্লাহ তা‘আলার সীমারেখা। আল্লাহ বলেন, تِلْكَ حُدُودُ اللهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا  ‘এসব আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা এগুলির নিকটেও যেয়ো না’ (বাক্বারাহ ১৮৭)

আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘনকারী ও হারাম অবলম্বনকারীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ভীতি প্রদর্শন করেছেন। তিনি বলেছেন,

وَمَن يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِداً فِيْهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ-

‘যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশের অবাধ্যতা করে এবং তাঁর সীমারেখাসমূহ লংঘন করে আল্লাহ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে চিরস্থায়ী হবে। আর তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি’ (নিসা ১৪)

এজন্যেই হারাম থেকে বিরত থাকা ফরয। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَا نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ فَاجْتَنِبُوهُ وَمَا أَمَرْتُكُمْ بِهِ فَافْعَلُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ-

‘আমি তোমাদেরকে যা কিছু নিষেধ করি তোমরা সেসব থেকে বিরত থাক। আর যা কিছু আদেশ করি তা যথাসাধ্য পালন কর’।[2]

লক্ষ্যণীয় যে, প্রবৃত্তিপূজারী, দুর্বলমনা ও স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী কিছু লোক যখন এক সঙ্গে কিছু হারামের কথা শুনতে পায় তখন অাঁতকে ওঠে এবং বিরক্তির সুরে বলে, ‘সবই তো হারাম হয়ে গেল। তোমরা তো দেখছি আমাদের জন্য হারাম ছাড়া কিছুই বাকী রাখলে না। তোমরা আমাদের জীবনটাকে সংকীর্ণ করে ফেললে, মনটাকে বিষিয়ে দিলে! জীবনটা একেবারে মাটি হয়ে গেল। কোন কিছুর সাধ-আহলাদই আমরা ভোগ করতে পারলাম না। শুধু হারাম হারাম ফৎওয়া দেয়া ছাড়া তোমাদের দেখছি আর কোন কাজ নেই। অথচ আল্লাহর দ্বীন সহজ-সরল। তিনি নিজেও ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আর শরী‘আতের গন্ডিও ব্যাপকতর। সুতরাং হারাম এত সংখ্যক হ’তে পারে না’।

এদের জবাবে আমরা বলব, ‘আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা আদেশ করতে পারেন। তাঁর আদেশকে খন্ডন করার কেউ নেই। তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। সুতরাং তিনি যা ইচ্ছা হালাল করেছেন এবং যা ইচ্ছা হারাম করেছেন। তিনি পূত-পবিত্র। আল্লাহর দাস হিসাবে আমাদের নীতি হবে তাঁর আদেশের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়া। কেননা তাঁর দেয়া বিধানাবলী জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ইনছাফ মুতাবেকই প্রকাশ পেয়েছে। সেগুলি নিরর্থক ও খেলনার বস্ত্ত নয়। যেমন তিনি বলেছেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقاً وَّعَدْلاً لاَّ مُبَدِّلِ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ  ‘তোমার প্রতিপালকের বাণী সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে পরিপূর্ণ হ’ল। তাঁর বাণীসমূহকে পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (আন‘আম ১১৫)

যে নিয়মের ভিত্তিতে হালাল-হারাম নির্ণিত হয়েছে আল্লাহ তা‘আলা তাও আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَآئِثَ  ‘তিনি পবিত্র বস্ত্তকে তাদের জন্য হালাল এবং অপবিত্র বস্ত্তকে হারাম করেন’ (আ‘রাফ ১৫৭)

সুতরাং যা পবিত্র তা হালাল এবং যা অপবিত্র তা হারাম। কোন কিছু হালাল ও হারাম করার অধিকার একমাত্র আল্লাহরই। কোন মানুষ নিজের জন্য তা দাবী করলে কিংবা কেউ তা অন্যের জন্য সাব্যস্ত করলে সে হবে একজন বড় কাফির ও মুসলিম উম্মাহ বহির্ভূত ব্যক্তি। আল্লাহ বলেন, أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوْا لَهُم مِّنَ الدِّيْنِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ-  ‘তবে কি তাদের এমন সব উপাস্য রয়েছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের এমন সব বিধান দিয়েছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি’ (শূরা ২১)

কুরআন-হাদীছে পারদর্শী আলেমগণ ব্যতীত হালাল-হারাম সম্পর্কে কথা বলার অধিকার অন্য কারো নেই। যে ব্যক্তি না জেনে হালাল-হারাম সম্পর্কে কথা বলে আল-কুরআনে তার সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন-

وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلاَلٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللهِ الْكَذِبَ-

‘তোমাদের জিহবায় মিথ্যা উচ্চারিত হয় বলে তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপের মানসে বল না যে, এটা হালাল, ওটা হারাম’ (নাহল ১১৬)

যেসব বস্ত্ত অখন্ডনীয়ভাবে হারাম তা কুরআন ও হাদীছে উল্লেখ আছে। যেমন আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئاً وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ-

‘আপনি বলুন, এসো, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তা পড়ে শুনাই। তোমরা তার সঙ্গে কাউকে শরীক করো না, মাতা-পিতার সাথে সদাচরণ করবে আর দারিদ্রে্যর কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না’ (আন‘আম ১৫১)

অনুরূপভাবে হাদীছেও বহু হারাম জিনিসের বিবরণ এসেছে। যেমন- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন- إِنَّ اللهَ حَرَّمَ بَيْعَ الْخَمْرِ وَالْمَيْتَةِ وَالْخِنْزِيرِ وَالأَصْنَامِ  ‘আল্লাহ তা‘আলা মদ, মৃত প্রাণী, শূকর ও মূর্তি কেনা-বেচা হারাম করেছেন’।[3]

অপর হাদীছে এসেছে, إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ إِذَا حَرَّمَ شَيْئاً حَرَّمَ ثَمَنَهُ  ‘আল্লাহ যখন কোন কিছু হারাম করেন তখন তার মূল্য তথা কেনা-বেচাও হারাম করে দেন’।[4]

কোন কোন আয়াতে কখনো একটি বিশেষ শ্রেণীর হারামের আলোচনা দেখতে পাওয়া যায়। যেমন হারাম খাদ্যদ্রব্য প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন,

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيْرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوْذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيْحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلاَّ مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَن تَسْتَقْسِمُوْا بِالْأَزْلاَمِ-

‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে যবেহকৃত প্রাণী, গলা টিপে হত্যাকৃত প্রাণী, পাথরের আঘাতে নিহত প্রাণী, উপর থেকে নীচে পড়ে গিয়ে মৃত প্রাণী, শিং এর আঘাতে মৃত প্রাণী, হিংস্র প্রাণীর ভক্ষিত প্রাণী। অবশ্য (উল্লেখিত ক্ষেত্রগুলিতে যে সব হালাল প্রাণীকে) তোমরা যবেহ করতে সক্ষম হও সেগুলি হারাম হবে না। আর (তোমাদের জন্য হারাম) সেইসব প্রাণী যেগুলি পূজার বেদীমূলে যবেহ করা হয় এবং ভাগ্য নির্ণায়ক তীরের সাহায্যে যে গোশত তোমরা বণ্টন কর’ (মায়েদাহ ৩)

হারাম বিবাহ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالاَتُكُمْ وَبَنَاتُ الْأَخِ وَبَنَاتُ الْأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمُ اللاَّتِيْ أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُم مِّنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَآئِكُمْ-

‘তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতৃকুল, কন্যাকুল, ভগ্নিকুল, ফুফুকুল, খালাকুল, ভ্রাতুষ্পুত্রীকুল, ভগ্নিকন্যাকুল, স্তন্যদাত্রী মাতৃকুল, স্তন্যপান সম্পর্কিত ভগ্নীকুল ও শাশুড়ীদেরকে’ (নিসা ২৩)

উপার্জন বিষয়ক হারাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন- أَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا  ‘আল্লাহ তা‘আলা কেনা-বেচা হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২৭৫)

বস্ত্ততঃ মানুষের প্রতি পরম দয়ালু আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য সংখ্যা ও শ্রেণীগতভাবে এত পবিত্র জিনিস হালাল করেছেন যে, তা গুণে শেষ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই তিনি হালাল জিনিসগুলির বিস্তারিত বিবরণ দেননি। কিন্তু হারামের সংখ্যা যেহেতু সীমিত এবং সেগুলি জানার পর মানুষ যেন তা থেকে বিরত থাকতে পারে সেজন্য তিনি উহার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। আল্লাহ বলেন, وَقَدْ فَصَّلَ لَكُم مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلاَّ مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ  ‘তিনি তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ তোমাদেরকে দান করেছেন। তবে তোমরা যে হারামটা বাধ্য হয়ে বা ঠেকায় পড়ে করে ফেল তা ক্ষমার্হ’ (আন‘আম ১১৯)

হারামকে এভাবে বিস্তারিত পেশের কথা বললেও হালালকে কিন্তু সংক্ষেপে সাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُواْ مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلاَلاً طَيِّباً  ‘হে মানবকুল! তোমরা যমীনের বুকে যা কিছু হালাল ও উৎকৃষ্ট সেগুলি খাও’ (বাক্বারাহ ১৬৮)

হারামের দলীল সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত সব জিনিসের মূল হুকুম হালাল হওয়াটা মহান আল্লাহর পরম করুণা। এটা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ এবং তাঁর বান্দাদের উপর সহজীকরণের নিদর্শন স্বরূপ। সুতরাং তাঁর আনুগত্য প্রকাশ, প্রশংসা ও শুকরিয়া জ্ঞাপন করা আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য।

কিন্তু পূর্বোল্লেখিত ঐসব লোক যখন তাদের সামনে হারামগুলি বিস্তারিত দেখতে পায় তখন শরী‘আতের বিধি-বিধানের ব্যাপারে তাদের মন সংকীর্ণতায় ভোগে। এটা তাদের ঈমানী দুর্বলতা ও শরী‘আত সম্পর্কে অনুধাবন শক্তির স্বল্পতার ফসল।

আসলে তারা কি চায় যে, হালালের শ্রেণীবিভাগগুলিও তাদের সামনে এক এক করে গণনা করা হোক যাতে তারা দ্বীন যে একটা সহজ বিষয় তা জেনে আত্মতৃপ্ত হতে পারে?

তারা কি চায় যে, নানা শ্রেণীর পবিত্র জিনিসগুলি তাদের সামনে এক এক করে তুলে ধরা হোক, যাতে তারা নিশ্চিত হতে পারে যে, শরী‘আত তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে দেয়নি। তারা কি চায় যে এভাবে বলা হোক?-

-উট, গরু, ছাগল, খরগোশ, হরিণ, পাহাড়ী ছাগল, মুরগী, কবুতর, হাঁস, রাজহাঁস, উটপাখি ইত্যাকার যবেহকৃত প্রাণীর গোশত হালাল।

-মৃত পঙ্গপাল ও মাছ হালাল।

-শাক-সবজি, ফলমূল, সকল দানাশস্য ও উপকারী ফল-ফুল হালাল। পানি, দুধ, মধু, তেল ও শিরকা হালাল। লবণ, মরিচ ও মসলা হালাল।

-লোহা, বালু, খোয়া, প্লাস্টিক, কাঁচ ও রাবার ইত্যাদি ব্যবহার হালাল।

-খাট, চেয়ার, টেবিল, সোফা, তৈজসপত্র, আসবাবপত্র ইত্যাদি ব্যবহার হালাল।

-জীবজন্তু, মোটরগাড়ী, রেলগাড়ী, নৌকা, জাহাজ ও বিমানে আরোহণ হালাল।

-এয়ারকন্ডিশন, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, পানি শুকানোর যন্ত্র, পেষণ যন্ত্র, আটা খামির করার যন্ত্র, কিমা তৈরীর যন্ত্র, ব্লেন্ডার মেশিন, সবরকমের ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি, জাহাজ তৈরী, নির্মাণ বিষয়ক যন্ত্রপাতি, হিসাব রক্ষণ, পর্যবেক্ষণ যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার এবং পানি, পেট্রোল, খনিজদ্রব্য উত্তোলন ও শোধন, মুদ্রণ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি হালাল।

-সূতী, কাতান, পশম, নাইলন, পলেস্টার ও বৈধ চামড়ার তৈরী বস্ত্র হালাল।

-বিবাহ, বেচা-কেনা, যিম্মাদারী, চেক, ড্রাফট, মনিঅর্ডার, ইজারা বা ভাড়া প্রদান হালাল।

-বিভিন্ন পেশা যেমন কাঠমিস্ত্রীগিরি, কর্মকারগিরি, যন্ত্রপাতি মেরামত, ছাগপালের রাখালী ইত্যাদি হালাল।

এভাবে গুনলে আর বর্ণনা করলে পাঠকের কি মনে হয় আমরা হালালের ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করতে পারব? তাহলে এসব লোকের কি হ’ল যে, তারা যে কোন কথাই বুঝতে চায় না?

দ্বীন যে সহজ তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবুও একথা বলে যারা সব কিছুই হালাল প্রমাণ করতে চায় তাদের কথা সত্য, কিন্তু উদ্দেশ্য খারাপ। কেননা দ্বীনের মধ্যে কোন কিছু মানুষের মর্যি মাফিক সহজ হয় না। তা কেবল শরী‘আতে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবেই নির্ধারিত হবে। অপর দিকে ‘দ্বীন সহজ’ এরূপ বাতিল দলীল দিয়ে হারাম কাজ করা আর শরী‘আতের অবকাশমূলক দিক গ্রহণ করার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। অবকাশমূলক কাজের উদাহরণ হ’ল সফরে দু’ওয়াক্তের ছালাত একত্রে পড়া, ক্বছর করা, সফরে ছিয়াম ভঙ্গ করা, মুক্বীমের জন্য একদিন এক রাত এবং মুসাফিরের জন্য তিনদিন তিন রাত মোযার উপর মাসেহ করা, পানি ব্যবহারের অসুবিধা থাকলে তায়াম্মুম করা, অসুস্থ হ’লে কিংবা বৃষ্টি নামলে দু’ওয়াক্তের ছালাত একত্রে পড়া, বিবাহের প্রস্তাবদাতার জন্য গায়ের মাহরাম মহিলাকে দেখা, শপথের কাফফারায় দাস মুক্তি, আহার করানো, বস্ত্র দান, ছিয়াম পালনের যে কোন একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা (মায়েদা ৮৯), নিরূপায় হলে মৃত প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করা ইত্যাদি।

মোটকথা, শরী‘আতে যখন হারাম আছে তখন সকল মুসলমানের জন্যই উহার মধ্যে যে গূঢ় রহস্য বা তত্ত্ব লুকিয়ে আছে তা জানা দরকার। যেমন-

(১) আল্লাহ তা‘আলা হারাম দ্বারা তার বান্দাদের পরীক্ষা করেন। তারা এ সম্পর্কে কেমন আচরণ করে তা তিনি লক্ষ্য করেন।

(২) কে জান্নাতবাসী হবে আর কে জাহান্নামবাসী হবে হারামের মাধ্যমে তা নির্ণয় করা চলে। যারা জাহান্নামী তারা সর্বদা প্রবৃত্তির পূজায় মগ্ন থাকে, যা দিয়ে জাহান্নামকে ঘিরে রাখা হয়েছে। আর যারা জান্নাতী তারা দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণ করে, যে দুঃখ-কষ্ট দিয়ে জান্নাতকে বেষ্টন করে রাখা হয়েছে। এ পরীক্ষা না থাকলে বাধ্য হ’তে অবাধ্যকে পৃথক করা যেত না।

(৩) যারা ঈমানদার তারা হারাম ত্যাগজনিত কষ্ট সহ্য করাকে সাক্ষাৎ পুণ্য এবং আল্লাহ তা‘আলার যে কোন নির্দেশ পালনকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উপায় বলে মনে করে। ফলে কষ্ট স্বীকার করা তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যারা কপট ও মুনাফিক্ব তারা কষ্ট সহ্য করাকে যন্ত্রণা, বেদনা ও বঞ্চনা বলে মনে করে। ফলে ইসলামের পথে চলা তাদের জন্য কঠিন এবং সৎ কাজ সম্পাদন ও আনুগত্য স্বীকার করা ততধিক কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।

(৪) একজন সৎ লোক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনার্থে হারাম পরিহার করলে বিনিময়ে তার চেয়ে যে উত্তম কিছু পাওয়া যায় তা ভালমত অনুধাবন করতে পারে। এভাবে সে তার মনোরাজ্যে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে।

আলোচ্য পুস্তকের মধ্যে সম্মানিত পাঠক শরী‘আতে হারাম বলে গণ্য এমন কিছু সংখ্যক নিষিদ্ধ বিষয়ের বিবরণ পাবেন কুরআন-সুন্নাহ থেকে সেগুলো হারাম হওয়ার দলীলসহ। এসব হারাম এমনই যা আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বহুসংখ্যক মুসলমান নির্দ্বিধায় তা হরহামেশা করে চলেছে। আমরা কেবল মানুষের কল্যাণ কামনার্থে তাদের সামনে এগুলি তুলে ধরেছি অতি সংক্ষেপে।



[1]. হাকেম, দারাকুৎনী; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২২৫৬।

[2]. মুসলিম, হা/১৩৩৭ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায়।

[3]. আবুদাঊদ হা/৩৪৮৬, সনদ ছহীহ।

[4]. দারাকুৎনী, ইবনু হিববান হা/৪৯৩৮, সনদ ছহীহ।