ইসলামী আন্দোলনে বিজয়ের স্বরূপ

উপসংহার

উপরে উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সবশেষে বলা যায় যে, দাওয়াত দাতার বিজয় ও আল্লাহর সাহায্য লাভের স্বরূপ নিম্নের কয়েকটি দফার সাথে যুক্ত। যেমন-

(১) সকল বিষয় থেকে বিমুক্ত হয়ে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা এবং খাঁটি মনে তার কাজ করা : আল্লাহ বলেন,

قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَاْ أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ-

‘বলুন! আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবকিছুই আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র সৃষ্টির প্রতিপালক। তাঁর কোন শরীক নেই। এ কথা বলতেই আমি আদিষ্ট হয়েছি, আর আমিই প্রথম আত্মসমর্পণকারী’ (আন‘আম ৬/১৬২-১৬৩) অন্যত্র তিনি বলেন,

وَمَا أُمِرُوْا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَاءَ وَيُقِيْمُوْا الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوْا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ -

‘তাদেরকে (আহলে কিতাব, কাফির, মুশরিক ইত্যাকার সকল শ্রেণীর মানুষকে) কেবল এই আদেশই দেওয়া হয়েছে যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, ছালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে। আর সেটাই হ’ল সরল দ্বীন’ (বাইয়িনাহ ৯৮/৫)। তাই যে আমল আললাহর জন্য খাuঁটভাবে ও নিষ্ঠার সাথে পালিত হয় না, তা প্রত্যাখ্যাত ও অগ্রাহ্য হওয়ারই সবচেয়ে বেশী  উপযুক্ত।

(২) সদা সর্বদা নিখুঁত কর্মনীতি অবলম্বন করা :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ যে আদর্শের উপর ছিলেন তদনুযায়ী গৃহীত কর্মনীতি হ’ল নিখুঁত কর্মনীতি। এটাই হ’ল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের কর্মনীতি, সাহায্যপ্রাপ্ত ও মুক্তিপ্রাপ্ত দলের কর্মনীতি। যাদেরকে কোন অপমান বা কোনরূপ বিরোধিতা সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। তারা সত্যের নির্ভীক সৈনিক হিসাবেই থেকে যাবে যতদিন না আল্লাহর আদেশ তথা ক্বিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। আল্লাহ বলেন,

وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْماً فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهِ -

‘এই আমার পথ, যা সরল-সোজা। সুতরাং তোমরা কেবল উহারই অনুসরণ কর। অন্য সব পথের অনুসরণ করো না। নচেৎ এরা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে’ (আন‘আম ৬/১৫৩)। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضاَءِ لَيْلُهَا كَنَهَارهَا لاَ يَزِيْغُُ عَنْهَا بَعْدِىْ إِلاَّ هَالِكَ- ‘আমি তোমাদেরকে একটি উজ্জ্বল মিল্লাত বা আদর্শের উপর রেখে যাচ্ছি, যার জন্য রাত-দিন উভয়ই সমান। আমার মৃত্যুর পর এই মিল্লাত থেকে যে দূরে সরে যাবে কেবল সেই ধ্বংসে নিপতিত হবে।’

(৩) প্রচারক যে বিষয়ের প্রতি আহবান জানাবেন উক্ত বিষয় নিজে পূর্ণরূপে আকঁড়ে ধরা ও আমরণ তার উপর অবিচল থাকা :

আল্লাহ বলেন,

فَاسْتَمْسِكْ بِالَّذِْي أُوحِيَ إِلَيْكَ إِنَّكَ عَلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِْيمٍ-

‘সুতরাং আপনার নিকট যে অহি বা প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছে আপনি তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকুন। নিশ্চয়ই আপনি সরল পথে আছেন’ (যুখরূফ ৪৩/৪৩)। অন্যত্র তিনি বলেন,

وَمَنْ يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى-

‘যে ব্যক্তি সৎকর্মশীল হয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে সে এক মযবুত রশিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে’ (লোক্বমান ৩১/২২)

أَتَأْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُوْنَ الْكِتَابَ أَفَلاَ تَعْقِلُوْنَ، وَاسْتَعِيْنُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيْرَةٌ إِلاَّ عَلَى الْخَاشِعِيْنَ-

‘তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে আর নিজেদের বেলায় ভুলে থাকবে! অথচ তোমরা কিতাব অধ্যয়ন কর। তোমরা কি কিছুই বুঝ না? তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই বিনয়ীগণ ব্যতীত আর সকলের নিকট উহা বড়ই কঠিন’ (বাক্বারাহ ২/ ৪৪-৪৫)

সুতরাং কর্মপদ্ধতির উপর অটল থাকা সাহায্য লাভের শক্তিশালী উপকরণ ও চিহ্ন। বরং দেখা যায়, বাতিলপন্থী কোন ব্যক্তি যখন তার বাতিল মতের উপর অনড় থাকে তখন প্রায়শঃ সে জয়লাভ করে। অথচ তার লক্ষ্য কেবল এই পৃথিবীতেই অর্জিত হয়। তাহ’লে যে সত্য পথের উপর আছে সে কেন বিজয়ী হবে না?

(৪) সত্যকে প্রকাশ্যে প্রচার করা, শিথিলতা প্রদর্শন না করা, প্রতারণা না করা এবং সর্বদা অকুতোভয় থাকা : আল্লাহ বলেন,

فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ-

‘অনন্তর আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং মুশরিকদেরকে উপেক্ষা করুন। বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আপনার জন্য আমিই যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,

وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ-

‘আপনি বলুন, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত। সুতরাং যার ইচ্ছা ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা কাফির থাকুক’ (কাহ্ফ ১৮/২৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,

يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ-

 ‘হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের নিকট থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার করুন। যদি তা না করেন তবে তো আপনি তাঁর বার্তা প্রচার করলেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন’ (মায়েদাহ ৫/ ৬৭)

(৫) ধৈর্যধারণ, হতাশ না হওয়া এবং আল্লাহর বান্দাদের জন্য তাঁর প্রতিশ্রুত সাহায্য লাভে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা :

আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,

وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ، إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُورُوْنَ، وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُوْنَ-

‘আমার প্রেরিত বান্দাদের জন্য আমার কথা আগে স্থির হয়ে আছে যে, তারা অবশ্যই সাহায্য প্রাপ্ত হবে এবং আমার বাহিনীই হবে বিজয়ী’ (ছাফফাত ৩৭/১৭১-৭৩)। অন্যত্র তিনি বলেন,

إنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا فِى الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ َيَقُوْمُ الْأَشْهاَدُ-

‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে ও মুমিনদেরকে পার্থিব জীবনে এবং যেদিন সাক্ষীগণ দন্ডায়মান হবে সেদিন সাহায্য করব’ (মুমিন ৪০/ ৫১)। আল্লাহ আরো বলেন,

حَتَّى إِذَا اسْتَيْأَسَ الرُّسُلُ وَظَنُّواْ أَنَّهُمْ قَدْ كُذِبُواْ جَاءَهُمْ نَصْرُنَا-

 ‘এমনকি যখন রাসূলগণ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁদের ধারণা হয়েছিল যে, তাঁদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, এমনি সময় তাঁদের নিকট আমাদের সাহায্য এসে পেঁŠছল’ (ইউসুফ ১২/১১০)فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِل لَّهُمْ - ‘সুতরাং আপনি ধৈর্যধারণ করুন, যেমন করে ধৈর্যধারণ করেছিলেন দৃঢ়চেতা রাসূলগণ এবং তাঁদের জন্য তাড়াহুড়া করবেন না’ (আহক্বাফ ৪৬/৩৫)فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَلاَ يَسْتَخِفَّنَّكَ الَّذِيْنَ لَا يُوْقِنُوْنَ - ‘সুতরাং আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। যারা অবিশ্বাসী তারা যেন আপনাকে অস্থিরমতি না ভাবে’ (রূম ৩০/৬০)। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ اصْبِرُوْاْ وَصَابِرُواْ وَرَابِطُواْ وَاتَّقُواْ اللّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ -

‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর, ধৈর্যধারণে প্রতিযোগিতা কর, অটল-স্থির থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে’ (আলে ইমরান ৩/২০০)

উক্ত দফাগুলি যখন প্রচারকগণের মধ্যে এক সাথে বর্তমান থাকবে ইনশাল্লাহ তখনই সাহায্য নিশ্চিত হবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কখনই লংঘিত হবে না। বরং কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে এই দফাগুলি বাস্তবে ফুটে উঠলে সেটাই হবে মহাবিজয়। তারপরে যে সাহায্য আসবে তা হবে এই বিজয়েরই স্মারক ও চিহ্নবাহী। আল্লাহ রাববুল আলামীন সকল প্রচারক ও ইসলামী দলকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাহায্য ও বিজয়ের স্বরূপ বুঝার তাওফীক্ব দান করুন এবং তাঁর দ্বীনকে সর্বত্র বিজয়ী করুন- আমীন!!