ইসলামী আন্দোলনে বিজয়ের স্বরূপ

সূরা আছর : বিজয়ের মর্মবাণী

সূরা আছর একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সূরা। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এ সূরা সম্পর্কে বলেছেন,

لَوْ تَدَبَّرَ النَّاسُ هذِهِ السُّوْرَةَ لَوَسَعَتْهُمْ- ‘মানুষ যদি এই সূরা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করত, তাহ’লে আল্লাহর পথে চলার ক্ষেত্রে তাদের জন্য এই সূরা যথেষ্ট হ’ত।[1] উক্ত সূরায় খুব স্পষ্টভাবে বিজয়ের কর্মনীতি অঙ্কন করা হয়েছে। বিজয়ের পথ ও পদ্ধতি যে একটাই, সে কথার ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে সব রকম ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটানো হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা কসম খেয়ে বলেছেন, মানুষ মাত্রই ক্ষতির মধ্যে। সবাই ধ্বংসের মধ্যে। তারপর তিনি এক শ্রেণীর লোককে ক্ষতিগ্রস্ত মানবমন্ডলী থেকে ব্যতিক্রম হিসাবে ঘোষণা করেছেন। এই ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিরাই কেবল সফল, লাভবান ও বিজয়ী। অন্যরা নয়।

এই ব্যতিক্রমধর্মীদের মাঝে বিজয় ও সাফল্যের একত্রে চারটি গুণ বা শর্তের সমাবেশের কথা বলা হয়েছে। যথাঃ

(ক) ঈমান : اَلَّذِيْنَ أمَنُوْا ‘যারা ঈমান এনেছে’।

(খ) সৎকর্মশীলতা : وَعَمِِلُوْا الصّاَلِحَاتِ ‘যারা সৎকর্ম করে’।

(গ) হক্ব পথে থাকার জন্য পরষ্পরে উপদেশ দান: وَتََوَاصَوْا بِالْحَقِّ ‘যারা একে অপরকে হক পথে চলার উপদেশ দেয়’।

(ঘ) হক্ব পথে চলতে ধৈর্যধারণের জন্য পারষ্পরিক উপদেশ দান: وَتَوَاَصَوْا بِالصِّبْرِ ‘এবং যারা একে অপরকে ধৈর্য-সহিষ্ণুতার উপদেশ দেয়’।

এগুলিই হ’ল বিজয় লাভের শর্ত। যারা এই শর্তগুলি পূরণ করবে তারাই ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং মুক্তি পাবে। অর্থাৎ তারা বিজয়ী ও সফল হবে।

লক্ষণীয় হ’ল, আল্লাহ তা‘আলা বিজয়ের শর্তাবলীতে প্রচারের ফলাফল হাতে নাতে পাওয়ার কোন শর্ত আরোপ করেননি। এ শর্তও করেননি যে, প্রচারের ফলে সব লোকের হেদায়াত পেতে হবে বা প্রচারকদের আহবানে সবাইকে সাড়া দিতে হবে। মুসলমান যখন অত্র সূরায় উল্লেখিত চারটি র্শত পূরণ করবে, তখনই তাদের ক্ষতির হাত থেকে মুক্তি ও বিজয় লাভের ফায়ছালা আল্লাহ শুনিয়েছেন। অন্যরা মুসলমানের দাওয়াতে সাড়া দিবে কিংবা তার লক্ষ্য অর্জিত হবে, নইলে সে যে ক্ষতি থেকে মুক্তি পাবে না, এমন কথা এখানে নেই। এসব কাজ প্রচারকের দায়িত্বে বর্তায় না। সাহায্য ও বিজয় লাভে এটি কোন আবশ্যকীয় দিকও নয়। এটি আল্লাহরই অনুগ্রহ ও অনুকম্পা (বাক্বারাহ ২/১০৫)। বরং এই সূরায় দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যক্ত হয়েছে। বিজয়ের সাথে তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

(১) একে অপরকে হক পথে চলার উপদেশ দান :

মানুষ অনেক সময় হক্ব পথে চলতে দুর্বলতা বোধ করে। কখনও তার পদস্খলন ঘটে; কখনও সে হক্ব পথ থেকে একেবারে বিচ্যুত হয়ে যায়। এজন্যই হক্ব পথে চলতে তার জন্য এমন সহযোগী দরকার যে তাকে সঠিক কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে উপদেশ দিবে, তার দেখভাল করবে এবং বিচ্যুতি হ’তে রক্ষা করবে।

অধিকাংশই মনে করে তারা হক পথে রয়েছে, অথচ কখন যে তারা হক্ব পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ভুল পথের অনুগামী হয়েছে তা তারা মোটেই বুঝতে পারে না। তারপরও তারা বলে, আমরা কেন বিজয়ী হ’তে পারলাম না? আমাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য পিছিয়ে যাওয়ার রহস্য কি? ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدَ أَنْفُسِكُمْ. ‘আপনি বলুন, তাতো তোমাদের নিজেদেরই কারণে’ (আলে ইমরান ৩/১৬৫)

সুতরাং হক পথে চলতে পারষ্পরিক উপদেশ দান করা বিজয় ও সাহায্য নিশ্চিত করার অন্যতম উপায়, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাদের প্রদানের অঙ্গীকার করেছেন। এরূপ উপদেশ দান সমাজে চালু থাকলে মানুষ ‘ছিরাতুল মুস্তাক্বীম’ বা ইসলামের অভ্রান্ত সরল পথে অবিচল থাকতে সক্ষম হয়। বিচ্যুতির ভয় থাকে না।

(২) হক পথে চলতে পারষ্পরিক ধৈর্য-সহিঞ্চুতার উপদেশ দান :

কোন জিনিসের সময় না হ’তেই উহার ত্বরিত ফল প্রত্যাশীদের জন্য বিজয় লাভ কখনই সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় আল্লাহর  রহমত থেকে হতাশ ব্যক্তির পক্ষে বিজয় লাভ। ধৈর্য-সহিষ্ণুতার পারষ্পরিক উপদেশে তাড়াহুড়া করার প্রবণতা দূর হয় এবং মুমিন হতাশ ও নৈরাশ্যের চোরাবালি থেকে মুক্তি পায়। এজন্যই কোন মুমিন বান্দা যখন হক পথ অবলম্বন করে, দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিহার করে দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে থাকে; লক্ষ্য অর্জনে তাড়াহুড়া করে না এবং তা বিলম্বিত হ’তে দেখে হতাশ হয় না বরং ধৈর্য ধরে, তখন বিজয় অবশ্যই তার পদচুম্বন করে। বরং এই হক পথ ও ধৈর্যকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারাই বিজয়। কেননা বিজয় অর্জন করতে হ’লে উক্ত দু’টি ব্যতীত লাভ করা সম্ভভ নয়।


[1]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৪/৫৪৭।