ইসলামী আন্দোলনে বিজয়ের স্বরূপ

পরিখাওয়ালাদের ঘটনা

আল্লাহ তা‘আলা পরিখাওয়ালাদের প্রসঙ্গে বলেছেন,

قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُوْدِ، النَّارِ ذَاتِ الْوَقُوْدِ، إِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُوْدٌ، وَهُمْ عَلَى مَا يَفْعَلُوْنَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ شُهُوْدٌ، وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَن يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْد-

‘ধ্বংস হোক ইন্ধনবিশিষ্ট আগুনের পরিখাওয়ালারা। যখন তারা তার পাশে উপবিষ্ট ছিল, আর মুমিনদের সঙ্গে কৃত আচরণ প্রত্যক্ষ করছিল। তাদের একটিই মাত্র অপরাধ ছিল যে, তারা পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল’ (বুরূজ ৮৫/৪-৮)

পরিখাওয়ালাদের ঘটনা খুবই বিস্ময়কর। যে বিজয়ের আলোচনা আমরা করছি এ দৃষ্টান্ত  তারই প্রতিচ্ছবি। মানুষ দলে দলে দ্বীন গ্রহণ করছে কিংবা বিজয়ীর আসনে দ্বীন আসীন হয়েছে- সেটাই যে বিজয় লাভের একমাত্র মাপকাঠি নয়; বরং প্রচারকের মানসিক দৃঢ়তা ও তার প্রোগ্রামের বিজয়ই যে চূড়ান্ত বিজয়, সে কথাই এ ঘটনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। ঘটনার গুরুত্ব হেতু এখানে হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) প্রদত্ত বর্ণনাটি সম্পূর্ণরূপে তুলে ধরা হ’ল-

ছুহাইব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্বযুগে একজন রাজা ছিল। তার ছিল এক যাদুকর। যাদুকর বুড়ো হয়ে গেলে রাজাকে বলল, আমার বয়সে ভাটা পড়েছে, কখন মরি কে জানে। আপনি একটি বালককে আমার নিকট পাঠিয়ে দিন আমি তাকে যাদু শিখিয়ে দেব। রাজা এক বালককে পাঠাল। এদিকে যাদুকর ও রাজার বাসভবনের মাঝে ছিল এক খৃষ্টান সাধু। বালকটি যাদুকরের নিকট যাদু শেখাকালে একদিন ঐ সাধুর ডেরায় গিয়ে উঠল। সাধুর কথা তার খুব মনে ধরল। ফলে সে প্রায়শ সেখানে আসতে যেতে সাধুর কথা শুনত। ফলে যাদুকরের কাছে যেতে এবং বাড়ি যেতেও তার বিলম্ব হ’ত। এভাবে দেরী হওয়ায় যাদুকর তাকে মার লাগাত আর বলত, কিসে আটকা পড়েছিলে? আবার বাড়িতে গেলেও বাড়ির লোকেরা মারত আর বলত, রোজ রোজ এত দেরী কেন? ফলে সাধুর নিকট সে অভিযোগ করলে তিনি তাকে বলে দিলেন, যাদুকর মারতে চাইলে তুমি বলবে, বাড়ির লোকেরা আমাকে আটকে রেখেছিল। আর বাড়ির লোকেরা মারতে চাইলে বলবে, যাদুকর ঠেকিয়ে রেখেছিল। এভাবে চলতে চলতে একদিন সে দেখতে পেল এক ভয়ঙ্কর জন্তু মানুষের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভয়ে কেউ রাস্তা পার হ’তে পারছে না। তখন সে মনে মনে বলল, আজ আমি জেনে নেব, সাধুর কাজটাই আল্লাহর নিকট প্রিয়, না যাদুকরের? তারপর সে একটা পাথর নিয়ে বলল, হে আল্লাহ! যাদুকরের কাজের তুলনায় যদি সাধুর কাজ আপনার নিকট বেশী প্রিয় ও সন্তোষজনক হয়, তাহ’লে এই জন্তুটাকে হত্যা করে জনগণের যাতায়াতের সুযোগ করে দিন। এই বলে সে পাথরটি ছুঁড়ে মারল, আর অমনি জন্তুটি মারা পড়ল। ফলে লোকদের চলাচল শুরু হ’ল। বিষয়টি সে সাধুকে অবহিত করল। সাধু শুনে বলল, হে বৎস! তুমি আমার থেকেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছ। তোমাকে এ জন্য অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হ’তে হবে। যদি তুমি এমন কোন পরীক্ষায় পড় তাহ’লে আমার ঠিকানা জানিয়ে দিও না।

তারপর থেকে সেই বালক জন্মান্ধ, কুষ্ঠ ও অন্য সব রকম রুগীকে সুস্থ করে তুলতে লাগল। এদিকে রাজার ছিল এক সভাসদ। সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বালকের কথা শুনে সে তার নিকট অনেক উপহার নিয়ে গিয়ে বলল, আপনি আমাকে সুস্থ করে তুলুন। সে বলল, আমি তো কাউকে সুস্থ করতে পারি না, সুস্থ করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তুমি যদি আল্লাহর উপর ঈমান আনতে পার, তাহ’লে আমি আল্লাহর শানে তোমার জন্য দো‘আ করতে পারি। সে ঈমান আনলে বালকটি তার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করে। ফলে সে আরোগ্য লাভ করে। তারপর সে রাজদরবারে গিয়ে আগে যেভাবে আসন গ্রহণ করত সেভাবে আসন গ্রহণ করল। রাজা তাকে দেখে বলল, আরে তুমি কী করে চোখ ফিরে পেলে? সে বলল, আমার প্রভু ফিরিয়ে দিয়েছেন। রাজা বলল, আমি? সে বলল, না। আমার ও আপনার প্রভু যিনি সেই আল্লাহ। এ কথা শুনে রাজা ক্ষেপে গেল এবং কিভাবে এমন ঘটল তা জানার জন্য তার উপর নির্যাতন শুরু করল। অবশেষে সে রাজাকে বালকের সন্ধান দিয়ে দিল।

অতঃপর বালককে ডেকে আনা হ’ল। রাজা তাকে বলল, ‘প্রিয় বৎস! তুমি যাদুতে এত উন্নতি করেছ যে, জন্মান্ধ, কুষ্ঠ ইত্যাদি সকল রোগ ভাল করে দিচ্ছ? সে বলল, আমি কাউকে সুস্থ করতে পারি না; সুস্থ করেন তো আল্লাহ। রাজা বলল, আমি? সে বলল, না। রাজা বলল, তোমার কি আমি ছাড়াও অন্য প্রভু আছে? সে বলল, আমার ও আপনার প্রভু আল্লাহ। রাজা তখন তাকেও শাস্তি দিতে আরম্ভ করলে নিরুপায় হয়ে সে সাধুর কথা বলে দিল। রাজা সাধুকে ধরে এনে বলল, তোমার দ্বীন ত্যাগ কর। কিন্তু সে অস্বীকার করল। তখন রাজা তার মাথার সিঁথিতে করাত লাগিয়ে  দেহ দু’ভাগ করে দিল। অতঃপর অন্ধকে দ্বীন ত্যাগ করতে বলল। কিন্তু সেও অস্বীকার করলে তাকেও একই পরিণতি বরণ করতে হ’ল। এবার এল বালকের পালা। সে দ্বীন ত্যাগে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে রাজা তাকে কিছু লোকের হাতে দিয়ে একটি পাহাড়ে পাঠিয়ে দিল এবং বলে দিল, ‘যখন তোমরা শৃঙ্গদেশে পৌঁছে যাবে, তখন যদি এই ছেলে তার দ্বীন ত্যাগ করে তো ভাল, নতুবা তাকে সেখান থেকে নীচে গড়িয়ে ফেলে দেবে। তারা তাকে নিয়ে পাহাড় শৃঙ্গে উঠলে সে আল্লাহর নিকট নিবেদন করল, হে আল্লাহ! তোমার যা ইচ্ছে তার বিনিময়ে আমাকে এদের হাত থেকে হেফাযত কর। তখন পাহাড়টি প্রবলবেগে কেঁপে উঠল এবং সাথে সাথে আগত লোকগুলি নীচে গড়িয়ে পড়ে নিহত হ’ল। বালক পথ খোঁজ করতে করতে রাজদরবারে পৌঁছে গেল। রাজা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, তোমার সাথের লোকদের কী হয়েছে? সে বলল, আল্লাহ তাদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছেন।

এবারে রাজা তাকে কিছু লোকের হাওয়ালায় একটি জাহাযে পাঠিয়ে দিল এবং বলে দিল, যখন তোমরা গভীর সমুদ্রে পৌঁছে যাবে তখন সে তার দ্বীন ত্যাগ করলে খুবই ভাল, নতুবা সমুদ্রে ডুবিয়ে মারবে। তারা তাকে গভীর সমুদ্রে নিয়ে গেল। সে সময় বালকটি এই বলে দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ! তুমি যা দিয়ে ইচ্ছে এদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর’। ফলে তারা সবাই ডুবে মারা গেল। বালক এসে রাজার সাথে সাক্ষাৎ করল। রাজা তো অবাক। রাজা নিজের লোকদের কথা তাকে জিজ্ঞেস করলে বালক বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।

তারপর বালক রাজাকে বলল, আমার আদেশ মত কাজ না করা পর্যন্ত আপনি যতই চেষ্টা করুন আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। রাজা বললেন, সেটা কি? বালক বলল, আপনি একটি প্রান্তরে সব লোক জমায়েত করবেন। তারপর আমাকে শূলে চড়িয়ে আমার তূণীর থেকে একটি তীর নিয়ে ‘বিসমিল্লাহি রবিবল গুলামি’ (এই বালকের প্রভু আল্লাহর নামে) বলে নিজে তীর ছুঁড়লেই কেবল আমাকে হত্যা করতে পারবেন। রাজা তাই করলেন এবং ধনুকে তীর জুড়ে উক্ত বাক্য বলে ছুঁড়ে মারল। তীর গিয়ে বালকের কানপট্টিতে লাগল। বালকটি তখন তীরবিদ্ধ স্থানে হাত দিয়ে মারা গেল। এ ঘটনা দেখে সমবেত জনতা বলে উঠল, ‘আমরা এই বালকের রবের প্রতি ঈমান  আনলাম’।

রাজাকে তখন বলা হ’ল, আপনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই তো ঘটে গেল। সব লোকই ঈমানদার হয়ে গেল। এ কথা শুনে রাজা গলির মুখ বন্ধ করে দিতে আদেশ দিলেন, যেন কোন লোক বাইরে যেতে না পারে এবং সেখানে অনেকগুলি পরিখা খননের আদেশ দিলেন। পরিখাগুলিতে আগুন উত্তপ্ত করা হ’ল। অতঃপর রাজা আদেশ দিলেন, যে ব্যক্তি বালকের দ্বীন ত্যাগ করবে তাকে তোমরা রেহাই দিবে, কিন্তু যারা তা করবে না তাদের সবাইকে আগুনে ফেলে হত্যা করবে। এমতাবস্থায় ঈমানদাররা দৌড়াদৌড়ি শুরু করল এবং একে অপরকে আগুনে পড়া থেকে ঠেকাতে লাগল। এ সময় এক মহিলাকে তার দুগ্ধপোষ্য শিশু সমেত হাযির করা হ’ল। মনে হচ্ছিল যেন সে আগুনে পড়া থেকে পিছিয়ে আসতে চাচ্ছে। তখন শিশুটি বলে উঠল, ‘মা তুমি ধৈর্য ধর, কেননা তুমি হক্বের উপর আছ’।

এই হ’ল পরিখাওয়ালাদের লম্বা ঘটনা। এই ঘটনাকে ঘিরে বিজয়ের যে হাক্বীক্বত সাইয়েদ কুতুব (রহঃ) বর্ণনা করেছেন তা খুবই হৃদয়গ্রাহী। এ জন্য প্রথমে এতদসম্পর্কে তাঁর কথা সংক্ষেপে তুলে ধরা হ’ল:

পার্থিব বিচারে এখানে ঈমানের উপর তাগূত্বী শক্তি তথা স্বৈরাচারের বিজয় ফুটে উঠেছে। সৎ, নম্র, দৃঢ়চেতা ও বিজয়ী একটি ক্ষুদ্র দলের অন্তরে যে ঈমান এতটা বুলন্দ পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছিল, ঈমান ও কুফরের মাঝে সংঘটিত লড়াইয়ে তার কোন মূল্যই হয়নি। এ ঈমান কোন হিসাবেও আসে না। তাই পার্থিব হিসাবে এ ঘটনার শেষ পরিণতি আমাদের জন্য আফসোস ও বেদনাই বয়ে আনে। পার্থিব হিসাব মানুষের মনে এই বেদনাবিধুর পরিণতি সম্পর্কে যা-ই ভাবিয়ে তুলুক না কেন, কুরআন কিন্তু মুমিনদেরকে অন্য শিক্ষা দেয়; উন্মোচিত করে আরেক রহস্য।

নিশ্চয়ই জীবন এবং জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা স্বাদ-আহ্লাদ, দুঃখ-বেদনা, ভোগ ও বঞ্চনাই হিসাবের খাতায় বড় মূল্যবান বস্ত্ত নয় এবং তা এমন কোন পণ্যও  নয় যা দিয়ে লাভ-লোকসান নির্ণিত হয়। আর বাহ্যিক বিজয়ের মধ্যেই সকল প্রকার জয় সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা নানা প্রকার জয়ের একটি।

সকল মানুষই মরণশীল, তবে প্রত্যেকের মৃত্যুর উপলক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সব লোকের ভাগ্যে উল্লিখিত ঈমানদারদের ন্যায় বিজয় জোটে না। সবাই ঈমানের এতটা উচ্চ শিখরে উঠতে পারে না। এতখানি অকুতোভয় ও স্বাধীনতা প্রদর্শন সবার কপালে জোটে না এবং সাহসের এতখানি উচ্চ স্তরে বিচরণ করার সৌভাগ্যও সকলের হয় না।

আল্লাহ তা‘আলাই তাঁর অপার অনুগ্রহে একদল মানুষকে বাছাই করে নেন, যারা অন্যান্য মানুষের মতই মৃত্যুবরণ করে কিন্তু তাদের মৃত্যুর উপলক্ষ হয় অনেক সম্মানজনক। বহু লোকই এই সৌভাগ্যের নাগাল পায় না। ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাই এই মানুষগুলির নাম যুগ যুগ ধরে ভাস্বর হয়ে আছে।

এই মুমিনগণ দ্বীন-ঈমান ত্যাগ করে তাঁদের জীবন বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তাতে তারা নিজেদের কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করতেন, আর সমগ্র মানবতা তাতে কতখানি ভূলুণ্ঠিত হ’ত তা কি পরিমাপ করা যেত? বিশ্বাসশূন্য জীবন অর্থহীন। বিশ্বাসের স্বাধীনতা বিহনে জীবন হয়ে পড়ে বিশ্বাদ। যালিম শাসকগোষ্ঠী দেহের উপর অত্যাচার চালিয়ে আত্মার উপরও শাসনদন্ড স্থাপন করতে পারলে মানবতার ক্ষতির আর কিইবা বাকী থাকে।

وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَن يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْدِ ‘পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর উপর বিশ্বাসই তো ওদের দৃষ্টিতে তাদের একমাত্র অপরাধ’ (বুরূজ ৮৫/৮)

এ এক জ্বলন্ত সত্য। আল্লাহর পথে আহবানকারী সকল দেশের সকল প্রজন্মের মুমিনদের এই সত্য গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। মূলতঃ মুমিন ও তাদের বিরুদ্ধ পক্ষের সংঘর্ষ উক্ত বিশ্বাসকে ঘিরেই, অন্য কিছুকে কেন্দ্র করে নয়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে শক্তি তাওহীদে বিশ্বাসকেই তাদের একমাত্র অপরাধ গণ্য করে। এই তাওহীদী আক্বীদাই তাদের ক্ষোভের অন্যতম কারণ।

সাইয়িদ কুতুবের এই সমীক্ষা উল্লেখের পর কিছু বক্তব্য  তুলে ধরা হ’ল:

(১) সাধু ও অন্ধের দৃঢ়তা :

অন্ধ লোকটি তার ঈমানকে বিজয়ী করার মুকাবেলায় জীবনের সকল স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছিলেন। সাধু লোকটিও আক্বীদা ও কুফরের সংঘর্ষে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি জীবনকে খুইয়ে বিনিময়ে ঈমান হেফাযত করেছেন। অন্ধ লোকটির জীবনে ঐ সামান্য সময়ে দু’বার বিজয় দেখা দিয়েছিল। (এক) রাজার নিকট তার যে পদমর্যাদা ছিল তা পরিত্যাগ করার সময়। এই পদমর্যাদা এক সময় তাকে অনেক প্রতিপত্তি ও মর্যাদার অধিকারী করেছিল। (দুই) বিশ্বাস রক্ষার্থে যখন সে জীবন বিসর্জন দিয়েছিল।

সাধু ও অন্ধ দু’জনেই আমাদের সামনে প্রকৃত বিজয়ের এক মহতী অর্থ স্থায়ীভাবে রেখে গেছেন। তারা এমনটা করেছেন কেবল দ্বীনের স্বার্থে। শাসকগোষ্ঠী যদি সত্যবাদী হ’ত তাহ’লে অবশ্যই জানতে পারত যে, দ্বীনের বিজয় মানে তাদের ঠিক সে কাজই করতে হবে যা সাধু ও অন্ধ লোকটি করেছে।

(২) বালকের বিস্ময়কর ভূমিকা :

বালকটি কেন রাজাকে তার হত্যার পন্থা বাতলে দিল? আর কেনইবা রাজার হাত থেকে আল্লাহর অনুগ্রহে বারবার রক্ষা পাওয়ার পরও সে তার প্রতিপালকের বাণী মানুষের মাঝে প্রচার এবং সত্য ধর্মের পথ নির্দেশ করতে জীবন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিল না? এ এক বিরাট প্রশ্ন, যা মানুষের মনে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে যারা বিজয়ের হাক্বীক্বত বুঝেনি তাদের মনে। আসলে বালকটি আল্লাহর রহমতে বুঝতে পেরেছিল যে, ‘সময়ের এক কথা এমন কিছু করতে পারে, যা অসময়ে কথিত হাযার কথা দিয়ে যুগ যুগ ধরেও করা সম্ভব নয়’।


(৩) জীবন নানা ঘাটের সমষ্টি :

জীবনে নানা ঘাট ও বাঁক ফিরে ফিরে আসে। এখানে কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী তা ফায়ছালা হয়ে যায়। কখনও এমন সুযোগ এসে যায় যাকে হাতছাড়া কিংবা নষ্ট করে সাফাই গাওয়া ঠিক হয় না। প্রবাদ আছে- ‘যখন তোমার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে সুবর্ণ সুযোগ হিসাবে গ্রহণ কর’। এই বালকের সুবাসও ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সুবাস তার প্রতিপালকের বাণী প্রচার ব্যতীত আর কিছু নয়। জীবনের এই বাঁকে এসে তার সত্যতা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। সে যদি পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর রাহে জীবন দিতে কুণ্ঠিত হ’ত তাহ’লে কি তার জীবনের এত মূল্য হ’ত?

(৪) বোধশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও আক্বীদার বিজয় :

বোধশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও বিশ্বাস যখন ব্যক্তির মনে একটি প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি ও সত্য জীবন হিসাবে পরিবর্তিত হয়, তখন এগুলির বিজয় অর্জিত হয়। জীবনের কোন পাদটীকা বা এলোমেলো আচরণ ও চিন্তা থেকে এরূপ শক্তি জন্মে না। বালকটির ক্ষেত্রে দেখা যায় সে প্রায় ক্ষেত্রে একাধিকবার উক্ত শক্তিতে বলীয়ান হয়েছে।

  • সে তার বোধ ও বিচার শক্তির বদৌলতে খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ে ও নিরাপদ উপায়ে তার দ্বীন ও আক্বীদাকে সাহায্য করতে সক্ষম হয়েছিল এবং তার জাতি ও সমাজকে কুফরির অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোয় নিয়ে আসতে পেরেছিল।
  • সে তার আত্মিক ক্ষমতাবলে জীবনের সকল চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, কামনা-বাসনা, ভোগ-বিলাস ও যাবতীয় পার্থিব সম্পদের লালসার ঊর্ধ্বে উঠে উপযুক্ত সময়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।
  • সে ঐ মূর্খ রাজার উপর জয়যুক্ত হয়েছিল, আল্লাহ তা‘আলা যার বিবেক-বুদ্ধিকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে স্বহস্তে সে নিজের রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছিল। বস্ত্তত: চোখ অন্ধ হয়ে যায় না; বরং অন্ধ হয় অন্তর, যা বক্ষের মাঝে বাস করে।
  • লোকে অবাক মনে ভাবে- বালকটি কেন রাজাকে তার হত্যার উপায় বাতলে দিল। কিন্তু তারা ভাবে না যে, এর ফলে রাজা নিজ হাতে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে। সুতরাং অবাক মানতে হ’লে কোনটি সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত? বালকটি কী ঘটতে  যাচ্ছে তার রহস্য সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকেও সাহস দেখিয়েছিল। কিন্তু রাজাকে রাজ্যের নেশা ও ক্ষমতার মত্ততা অন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে সে ঐ সিদ্ধান্তকারী সংঘর্ষে বালকের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিল। তাতে মারা গিয়েছিল একজন কিন্তু বেঁচে গিয়েছিল পুরো একটি জাতি।
  • বালকটি মনে মনে যে ধ্যান ও কামনা করত এবং যে জন্য সে জীবন উৎসর্গ করেছিল তা বাস্তবায়িত হওয়ার মাধ্যমে সে জয়যুক্ত হয়েছিল। তার এই মহান আত্মত্যাগের ফলে লোকেরা ঈমান এনেছিল। তারা বলেছিল, اَمَنَّا بِاللهِ رَبِّ الغُلاَمِ، ‘আমরা এই বালকের রব আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম’। নিশ্চয়ই কাজের সূক্ষ্ম নকশা প্রণয়ন, পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং পরিকল্পনার ত্রুটিহীনতা সুস্পষ্ট সফলতা ও প্রকাশ্য বিজয় বলেই গণ্য হয়।
  • আল্লাহর পথে শাহাদাত লাভের মাধ্যমেও বালক বিজয় লাভ করেছিল। মানুষ তো সবাই মরণশীল, কিন্তু শাহাদাতের সৌভাগ্য জোটে কম লোকেরই।
  • পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা বালকের নাম স্থায়ীভাবে খুদাই করে দিয়েছেন। তার কথা মুমিনদের মুখে মুখে ফেরে। পরবর্তী প্রজন্ম হামেশাই তার সুখ্যাতি করছে। এটাও  বালকের মহান বিজয়।