হিংসা ও অহংকার

অহংকারের কারণসমূহ

১. অন্যের সম্মান দেখে অহংকারী হওয়া :

আদমের উচ্চ সম্মান দেখে ইবলীস অহংকারী হয়ে ওঠে এবং সে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلاَّ إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ -

‘অতঃপর যখন আমরা ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর। তখন তারা সবাই সিজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে অস্বীকার করল এবং অহংকার দেখালো। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’ল (বাক্বারাহ ২/৩৪)

যুগে যুগে এটা জারি আছে। যেজন্য নবী-রাসূলগণ ও তাদের যথার্থ অনুসারীগণ সর্বদা অহংকারী সমাজনেতাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। যদিও অহংকারীরা সর্বদা নিজেদের সাফাই গেয়ে মিথ্যা বলে থাকে।

২. মালের আধিক্য :

অধিক ধন-সম্পদ মানুষকে অনেক সময় অহংকারী করে তোলে। মাল ও সন্তান মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। কিন্তু মানুষ অনেক সময় এর দ্বারা ফেৎনায় পতিত হয় এবং অহংকারে স্ফীত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল্লাহ ক্বারূণের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

إِنَّ قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لاَ تَفْرَحْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْفَرِحِينَ- ... قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا وَلاَ يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ-

‘ক্বারূণ ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল। আমরা তাকে এমন ধন-ভান্ডার দান করেছিলাম, যার চাবিসমূহ বহন করা একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিকদের পসন্দ করেন না।’ ... ‘সে বলল, এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞান বলে প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছেন, যারা তার চাইতে শক্তিতে প্রবল ছিল এবং সম্পদে প্রাচুর্যময় ছিল। আর অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না (তারা সরাসরি জাহান্নামে যাবে)’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৬, ৭৮)।

ক্বারূণী ধন সবাই পেতে চায়। কিন্তু তা মানুষকে অহংকারী করে তোলে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে। যেমন আল্লাহ বলেন,

فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ-

‘অতঃপর আমরা ক্বারূণকে ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে ধ্বসিয়ে দিলাম। ফলে তার পক্ষে এমন কোন দল ছিল না, যে আল্লাহর শাস্তি হতে তাকে সাহায্য করতে পারে এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮১)।

৩. ইলম :

ইলম অনেক সময় আলেমকে অহংকারী বানায়। দু’ধরনের লোকের মধ্যে এটা দেখা যায়। জন্মগতভাবে বদ চরিত্রের লোকেরা যখন ইলম শিখে, তখন ইলমকে তার বদস্বভাবের পক্ষে কাজে লাগায়। এইসব আলেমরা কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করে এবং নিজেকে অন্যদের তুলনায় বড় আলেম বলে যাহির করে। এদের মধ্যে ইলম থাকলেও সেখানে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি থাকে না। তাদের সকল কাজে লক্ষ্য থাকে দুনিয়া অর্জন করা ও মানুষের প্রশংসা কুড়ানো। যা তাদেরকে অহংকারী করে ফেলে। যেমন আববাসীয় যুগের শ্রেষ্ঠ কবি আবুত ত্বাইয়েব আহমাদ বিন হুসাইন আল-মুতানাববী (৩০৩-৩৫৪ হিঃ)[1] বলেন,

مَا مُقامِي بِأَرْضِ نَخْلَةَ إلاَّ + كمُقامِ الْمَسيحِ بين الْيَهُودِ

‘নাখলার জনপদে আমার অবস্থান ইহূদীদের মাঝে মসীহ ঈসার অবস্থানের ন্যায়।’

অনুরূপভাবে অন্ধ কবি আবুল ‘আলা আল-মা‘আররী (৩৬৩-৪৪৯ হিঃ) বলেন,

وأنِّي وإنْ كنتُ الأخيرَ زمانُهُ + لَآتٍ بِمَا لَمْ تَسْتَطِعْهُ الْأَوَائِلُ

‘আমি যদিও কালের হিসাবে শেষে এসেছি। তথাপি আমি যা এনেছি, তা পূর্বের লোকেরা আনতে সক্ষম হয়নি’।[2]

দ্বিতীয় কারণ হ’ল, অল্প বিদ্যা। যেমন কিছু ইলম শিখেই নিজেকে অন্যের তুলনীয় মনে করা এবং একথা বলা যে, هُمْ رِجَالٌ وَنَحْنُ رِجَالٌ ‘তারাও মানুষ ছিলেন, আমরাও মানুষ’।[3] অর্থাৎ আমরা ও তারা সমান। এটা তাদের অহংকারের পরিচয়। সেজন্যেই প্রবাদ আছে ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’। নিঃসন্দেহে পূর্ববর্তী বিদ্বানগণের মর্যাদা অনেক বেশী। কেননা তাদের ইলমের পথ ধরেই পরবর্তীরা এসেছেন। তাছাড়া সমকালীন প্রত্যেকেই পৃথক গুণ ও মেধার অধিকারী। অতএব কেউ কারু সমান নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। প্রত্যেকেই পৃথকভাবে সম্মান পাওয়ার যোগ্য।

প্রকৃত ইলম হ’ল সেটাই যা মানুষকে বিনয়ী ও আল্লাহভীরু বানায়। ইমাম মালেক বিন আনাস (৯৩-১৭৯ হিঃ)-কে ৪৮ টি প্রশ্ন করা হ’লে তিনি ৩২ টি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, لاَ أَدْرِي ‘আমি জানি না’।[4] বহু মাসআলায় তিনি বলতেন, তুমি অন্যকে জিজ্ঞেস কর।’ ‘কাকে জিজ্ঞেস করব? এরূপ প্রশ্নের উত্তরে তিনি কারু নাম না করে বলতেন, আলেমদের জিজ্ঞেস কর’। তিনি মৃত্যুকালে কাঁদতে থাকেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি আমার ‘রায়’ অনুযায়ী যত ফৎওয়া দিয়েছি প্রতিটির বদলায় যদি আমাকে চাবুক মারা হ’ত! ... হায় যদি আমি কোন ফৎওয়া না দিতাম!।[5] বহু ইখতেলাফী মাসআলায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) বলতেন, আমি জানি না’।[6]

ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হিঃ) বলতেন, عِلْمُنَا هَذَا رَأْيٌ وَهُوَ أَحْسَنُ مَا قَدَرْنَا عَلَيْهِ ، وَمَنْ جَاءَنَا بِأَحْسَنَ مِنْهُ قَبِلْنَاهُ مِنْهُ ‘আমাদের ইলম হ’ল ‘রায়’। আমাদের নিকটে এটাই সর্বোত্তম হিসাবে অনুমিত হয়েছে। যে ব্যক্তি এর চেয়ে উত্তম নিয়ে আসবে, আমরা তার কাছ থেকে সেটা গ্রহণ করব’।[7] পরবর্তী যুগে সালাফে ছালেহীনের একটা সাধারণ রীতি ছিল এই যে, তাঁরা নিজস্ব রায় থেকে কিছু লিখলে শেষে বলতেন, واللهُ أَعْلَمُ بِالصِّدْقِ وَالصَّوَابِ ‘আল্লাহ সত্য ও সঠিক সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত’।

সত্যসন্ধানী আল্লাহভীরু আলেমদের দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই কেবল আল্লাহকে ভয় করে থাকে’ (ফাত্বির ৩৫/২৮)। এখানে ‘আলেম’ বলতে দ্বীনী ইলমের অধিকারীদের বুঝানো হয়েছে। কেননা দুনিয়াবী ইলম কাফের-মুশরিকরাও শিখে থাকে। কিন্তু তারা আল্লাহভীরু নয়। আর দুনিয়াবী ইলম কাউকে আল্লাহভীরু বানায় না আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ব্যতীত।

পক্ষান্তরে যারা ইলমকে দুনিয়া হাছিলের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে, তাদের বিষয়ে হাদীছে কঠিন হুঁশিয়ারী এসেছে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ক্বিয়ামতের দিন প্রথম বিচার করা হবে শহীদ, আলেম ও দানশীল ব্যক্তিদের। অতঃপর দুনিয়াসর্বস্ব নিয়তের কারণে তাদেরকে উপুড়মুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[8] কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য হাদীছে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ইলম শিখল আলেমদের সাথে তর্ক করার জন্য এবং মূর্খদের সাথে ঝগড়া করার জন্য অথবা মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’।[9] আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত অন্য হাদীছে তিনি আরও বলেন, مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি ইলম শিখে যদ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, অথচ সে তা শিখে পার্থিব সম্পদ লাভের জন্য, ঐ ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’।[10]

অথচ যে ব্যক্তি স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মানুষকে কল্যাণের পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে ইলম শিক্ষা করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন। ফেরেশতারা তার (নিরাপত্তার জন্য) তাদের ডানাসমূহ বিছিয়ে দেন। তাছাড়া ফেরেশতামন্ডলী, আসমান ও যমীনবাসীগণ, এমনকি পানির মাছ ও গর্তের পিঁপড়ারাও তার জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ ও ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। এইসব আলেম হ’লেন ‘নবীগণের ওয়ারিছ’ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ অর্থাৎ তাঁদের ইলমের উত্তরাধিকারী। কেননা নবীগণ কোন দীনার ও দিরহাম ছেড়ে যাননি, কেবল ইলম ব্যতীত। যে ব্যক্তি সেই ইলম লাভ করেছে, সে ব্যক্তি পূর্ণভাবেই তা লাভ করেছে’ (অর্থাৎ সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ ইলম সে লাভ করেছে)।[11] নিজে ইলম না শিখলেও যে ব্যক্তি কুরআন ও হাদীছ এর ইলম যথাযথভাবে অন্যের নিকট পৌঁছে দিবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য দো‘আ করে বলেন, نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا شَيْئًا فَبَلَّغَهُ كَمَا سَمِعَ فَرُبَّ مُبَلَّغٍ أَوْعَى مِنْ سَامِعٍ আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার চেহারা উজ্জ্বল করুন! কেননা যার কাছে ইলম পৌঁছানো হয়, তিনি অনেক সময় শ্রবণকারীর চাইতে অনেক বেশী হেফাযতকারী বা জ্ঞানী হয়ে থাকেন’।[12]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলতেন, لَيْسَ الْعِلْمُ بِكَثْرَةِ الرِّوَايَةِ، إِنَّمَا الْعِلْمُ الْخَشْيَةُ ‘অধিক হাদীছ বর্ণনা প্রকৃত জ্ঞানার্জন নয়। বরং আল্লাহভীতিই হ’ল প্রকৃত জ্ঞান’।[13]

অতএব আল্লাহকে চেনা ও জানা এবং আল্লাহভীতি অর্জন করাই হ’ল ইলম হাছিলের মূল লক্ষ্য। আল্লাহভীতি সৃষ্টি হলেই বাকী সবকিছুর জ্ঞান তার জন্য সহজ হয়ে যায়। কুরআন ও হাদীছ হ’ল সকল ইলমের খনি। সেখানে গবেষণা করলে মানবীয় চাহিদার সকল দিক ও বিভাগ পরিচ্ছন্ন হয়ে গবেষকের সামনে ফুটে ওঠে। আল্লাহর রহমতে তার অন্তর জগত খুলে যায়। ফলে সে অহংকারমুক্ত হয়।

৪. পদমর্যাদা :

উচ্চ পদমর্যাদা মানুষের মধ্যে অনেক সময় অহংকার সৃষ্টি করে। মূর্খরা এটাকে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করে। জ্ঞানীরা এর মাধ্যমে মানব কল্যাণে অবদান রাখেন। পদমর্যাদা একটি কঠিন জওয়াবদিহিতার বিষয়। যিনি যত বড় দায়িত্বের অধিকারী, তাকে তত বড় জওয়াবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ، فَالإِمَامُ الَّذِى عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ وَهِىَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ ، وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهْوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ ، أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِه-ِ ‘মনে রেখ, তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাসাধারণের দায়িত্বশীল। তিনি তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। ব্যক্তি তার পরিবারের দায়িত্বশীল। সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর গৃহ ও সন্তানাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। চাকর তার মনিবের মাল-সম্পদ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[14]

যে ব্যক্তি পদমর্যাদা বা দায়িত্ব পেয়ে অহংকারী হয় এবং পদের অপব্যবহার করে, তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللهُ رَعِيَّةً يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ إِلاَّ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে লোকদের উপর দায়িত্বশীল নিয়োগ করেন। অতঃপর সে তাদের সাথে খেয়ানতকারী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন’।[15] মূলতঃ যুলুম-খেয়ানত সবকিছুর উৎপত্তি হয় পদমর্যাদার অহংকার থেকে। তাই জান্নাত পিয়াসী বান্দাকে এ বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرْفَعُ لَهُ بِقَدْرِ غَدْرِهِ أَلاَ وَلاَ غَادِرَ أَعْظَمُ غَدْرًا مِنْ أَمِيرِ عَامَّةٍ ‘ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের কোমরে একটা করে ঝান্ডা স্থাপন করা হবে। যা তার খেয়ানতের পরিমাণ অনুযায়ী উঁচু হবে। মনে রেখ, সেদিন সবচেয়ে উঁচু ঝান্ডা হবে প্রধান শাসকের খেয়ানতের ঝান্ডা’।[16] অতএব পদমর্যাদা যেন মনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি না করে; বরং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে কৈফিয়ত দেয়ার ভয়ে হৃদয় যেন সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে, আল্লাহর নিকটে সর্বদা সেই তাওফীক কামনা করতে হবে।

৫. বংশ মর্যাদা :

বংশ মর্যাদা মানুষের উচ্চ সম্মানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদন্ড। এই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে, যতক্ষণ বংশের লোকেরা বিনয়ী ও চরিত্রবান থাকে। উক্ত দু’টি গুণ যত বৃদ্ধি পায়, বংশের সম্মান ও মর্যাদা তত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যদি সেখানে কথায় ও আচরণে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়, তাহলে কচুর পাতার পানির মত উক্ত সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ أَوْحَى إِلَىَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لاَ يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ وَلاَ يَبْغِى أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ ‘আল্লাহ আমাকে প্রত্যাদেশ করেছেন যে, তোমরা বিনয়ী হও। তোমাদের কেউ যেন একে অপরের উপর গর্ব না করে এবং একে অপরের উপর ঔদ্ধত্য প্রদর্শন না করে’।[17]

তিনি বলেন, লোকেরা যেন তাদের (মুশরিক) বাপ-দাদার নামে গর্ব করা হ’তে বিরত থাকে, যারা মরে জাহান্নামের অঙ্গারে পরিণত হয়েছে ... নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অহমিকা ও বাপ-দাদার অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। এক্ষণে সে আল্লাহভীরু মুমিন (مُؤْمِنٌ تَقِيٌّ) অথবা হতভাগ্য পাপী (فَاجِرٌ شَقِيٌّ) মাত্র। মানবজাতি সবাই আদমের সন্তান। আর আদম হ’ল মাটির তৈরী’ (অতএব অহংকার করার মত কিছুই নেই)।[18] তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন,لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ ‘তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না, যেরূপ খ্রিষ্টানরা মারিয়ামপুত্র ঈসার ব্যাপারে করেছে। আমি আল্লাহর একজন বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা বলো, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[19]

সঙ্গত কারণে বিশেষ অবস্থায় বংশ মর্যাদাকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। যেমন (ক)  বৈবাহিক সমতার ক্ষেত্রে।[20] (খ) রাজনৈতিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে। যেমন পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে যান, الأَئِمَّةُ مِنْ قُرَيْشٍ ‘নেতা হবেন কুরায়েশদের মধ্য থেকে’।[21] তাঁর মৃত্যুর পরে খলীফা নির্বাচন নিয়ে মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হ’লে উক্ত হাদীছটির মাধ্যমে সব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। অতঃপর সবাই মুহাজির নেতা আবুবকর (রাঃ)-কে খলীফা হিসাবে মেনে নেন। এই সিলসিলা খেলাফতে রাশেদাহ, খিলাফতে বনু উমাইয়া ও আববাসীয় পর্যন্ত অব্যাহত  থাকে। (গ) যুদ্ধকালীন সময়ে। যেমন হোনায়েন যুদ্ধে শত্রুবেষ্টিত অবস্থায় সৃষ্ট মহা সংকটকালে দৃঢ়চেতা রাসূল (ছাঃ) খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে কাফেরদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, أَنَا النَّبِىُّ لاَ كَذِبْ، أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ ‘আমিই নবী মিথ্যা নই। আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের পুত্র।’ রাবী বলেন, সেদিন তাঁর চাইতে দৃঢ় কাউকে দেখা যায়নি’।[22]

এখানে তিনি আরবের শ্রেষ্ঠ বংশের নেতার পুত্র হিসাবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছেন। এর দ্বারা তিনি শত্রুদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান আমি বুক দিতে জানি, পিঠ দিতে জানি না। বস্ত্ততঃ তাঁর এই হুমকিতে দারুণ কাজ হয়। মাত্র ২০ দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী কুরায়েশ নেতা আববাস, আবু সুফিয়ান বিন হারেছ, হাকীম বিন হিযাম সহ অন্যেরা সবাই দ্রুত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে এসে দাঁড়ান এবং মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। শত্রুপক্ষ নিমেষে পরাজিত হয় ও পালিয়ে যায়।

বংশ মর্যাদার এই তারতম্যকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করলেই সেটা দোষের হয়। অন্যায়ভাবে বংশের গৌরব করাকে তিনি ‘জাহেলিয়াতের অংশ’ (عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ) বলে ধিক্কার দিয়েছেন।[23]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فَخِيَارُكُمْ فِى الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُكُمْ فِى الإِسْلاَمِ إِذَا فَقِهُوا তোমাদের মধ্যে যারা জাহেলী যুগে উত্তম ছিলে, তারা ইসলামী যুগেও উত্তম, যদি তারা দ্বীনের জ্ঞানে পারদর্শী হয়’।[24] হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর প্রশংসায় তিনি বলেন, الْكَرِيمُ ابْنُ الْكَرِيمِ ابْنِ الْكَرِيمِ ابْنِ الْكَرِيمِ يُوسُفُ بْنُ يَعْقُوبَ بْنِ إِسْحَاقَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ সম্ভ্রান্তের পুত্র সম্ভ্রান্ত। তাঁর পুত্র সম্ভ্রান্ত ও তাঁর পুত্র সম্ভ্রান্ত। তাঁরা হ’লেন ইবরাহীম, তাঁর পুত্র ইসহাক, তাঁর পুত্র ইয়াকূব এবং তাঁর পুত্র ইউসুফ’।[25] এতে বুঝা যায় যে, বংশমর্যাদা প্রশংসিত। কিন্তু অন্যায়ভাবে তার ব্যবহারটা নিন্দনীয়।

ইসলামে দ্বীন ও আল্লাহভীতিকে সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। যেমন দ্বীন ও তাক্বওয়ার কারণেই কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তদাস বেলাল উচ্চ সম্মান লাভ করেছিলেন। ওমর (রাঃ) বলতেন,أَبُو بَكْرٍ سَيِّدُنَا، وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا، يَعْنِى بِلاَلاً ‘আবুবকর আমাদের নেতা এবং তিনি মুক্ত করেছেন আমাদের নেতাকে (অর্থাৎ বেলালকে)’।[26] মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে কা‘বাগৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে আযান দিতে বলেন। তার এই উচ্চ সম্মান দেখে কুরায়েশ নেতারা সমালোচনা করেছিলেন।[27] ওযূ নষ্ট হলেই তাহিইয়াতুল ওযূ এবং আযানের পরেই মসজিদে তাহিইয়াতুল মাসজিদ-এর নফল ছালাত আদায়ের নিয়মিত সদভ্যাসের কারণেই জান্নাতে বেলালের অগ্রগামী পদশব্দ স্বপ্নের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শুনেছিলেন ও তার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন।[28]

বস্ত্ততঃ ইসলামের উদার সাম্যের কারণেই কুরায়েশ নেতা আবুবকর ও ওমরের পাশাপাশি পায়ে পা লাগিয়ে ছালাতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন আবিসিনিয়ার বেলাল হাবশী, রোমের ছুহায়েব রূমী, পারস্যের সালমান ফারেসী প্রমুখ ক্রীতদাসগণ। কোটি কোটি মুসলমান তাদের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে দো‘আ করে বলেন, ‘রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু’ (আল্লাহ তার উপরে সন্তুষ্ট হউন!)। স্রেফ দ্বীনের কারণে বেলাল এখানে উচ্চ সম্মানিত। পক্ষান্তরে কুফরীর কারণে তার মনিব উমাইয়া বিন খালাফ হলেন অপমানিত ও লাঞ্ছিত। অথচ তিনি ছিলেন অন্যতম কুরায়েশ নেতা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আপন চাচা ও নিকটতম প্রতিবেশী। অতএব ইসলামে বংশ মর্যাদা স্বীকৃত ও প্রশংসিত হলেও দ্বীন ও তাক্বওয়া না থাকলে তা নিন্দিত ও মূল্যহীন। এখানে সকলের সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হ’ল ঈমান ও তাক্বওয়া। মুসলমান সবাই ভাই ভাই। দাস-মনিবে কোন প্রভেদ নেই। পৃথিবীর কোন সমাজ ব্যবস্থায় এর কোন নযীর নেই। কেবল অহংকারী ব্যক্তিরাই এর বিপরীত আচরণ করে থাকে।

৬. ইবাদত ও নেক আমল :

ইবাদত ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হ’লেও তা অনেক সময় মুমিনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে।

বহু নেককার ও ইবাদতগুযার ব্যক্তি অলি-আউলিয়া, গাউছ-কুতুব-আবদাল, পীর-মাশায়েখ ইত্যাদি লকবে অভিহিত হন। তারা ভক্তের ভক্তি রসে আপ্লুত হ’তে ভালবাসেন। নযর-নেয়ায, পদসেবা গ্রহণ ইত্যাদি তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। যা তাদের মধ্যে লোভ ও অহংকার সৃষ্টি করে।

খাত্ত্বাবী বর্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হিঃ) একবার খোরাসানের এক বিখ্যাত দরবেশের খানক্বায় গেলেন। কিন্তু তিনি তাঁর দিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তখন তাকে বলা হ’ল, আপনি কি জানেন ইনি কে? ইনি হ’লেন আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীছ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক’। একথা শুনে দরবেশ দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে তাঁর নিকটে ওযর পেশ করলেন ও তাঁকে উপদেশ দিতে বললেন। তখন তিনি তাকে বললেন,إِذَا خَرَجْتَ مِنْ مَنْزِلِكَ فَلا يَقَعْ بَصَرُكَ عَلَى أَحَدٍ إِلا أُرِيتَ أَنَّهُ خَيْرٌ مِنْكَ ‘যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, তখন তুমি যাকেই দেখবে, তাকেই তোমার চাইতে উত্তম বলে মনে করবে’।[29]

পক্ষান্তরে সালাফে ছালেহীনের নীতি ছিল এই যে, তারা সর্বদা নিজেকে অন্যের চাইতে হীন মনে করতেন। যেমন (ক) বকর বিন আব্দুল্লাহ মুযানী (মৃঃ ১০৬ হিঃ) বলেন, نَظَرْتُ إِلَى أَهْلِ عَرَفَاتٍ ظَنَنْتُ أَنَّهُ قَدْ غُفِرَ لَهُمْ لَوْلاَ أَنِّي كُنْتُ فِيهِمْ بِهِ ‘আমি আরাফাতের ময়দানে অবস্থানরত সকলের দিকে দেখলাম এবং ভাবলাম যে, এদের সবাইকে ক্ষমা করা হয়েছে, যদি না আমি এদের মধ্যে থাকতাম’। অর্থাৎ কেবল আমাকেই ক্ষমা করা হয়নি।[30]

(খ) ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মুজাদ্দিদ খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (৬১-১০১ হিঃ)-কে বলা হ’ল, আপনি মারা গেলে আমরা আপনাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কক্ষে দাফন করব। জওয়াবে তিনি বললেন,لأن ألقى الله بكل ذنب غير الشرك أحب إلي من أن أرى نفسي أهلاً لذلك ‘শিরক ব্যতীত যাবতীয় পাপ নিয়ে আল্লাহর কাছে হাযির হওয়াটা আমার নিকট অধিক প্রিয় ঐ স্থানে কবরস্থ হওয়ার জন্য নিজেকে যোগ্য মনে করার চাইতে’।[31] এর মাধ্যমে তিনি নিজের হীনতা প্রকাশ করেছেন।

(গ) আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে বসেছিলাম। এমন সময় তিনি বললেন, ‘আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) মৃত্যুকালে স্বীয় পুত্রকে অছিয়ত করে বলেন, আমি তোমাকে দু’টি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি ও দু’টি বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি। নির্দেশ হ’ল তুমি বলবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। কেননা আসমান ও যমীনের সবকিছু যদি এক হাতে রাখা হয় এবং এটিকে যদি এক হাতে রাখা হয়, তাহলে এটিই ভারি হবে। দ্বিতীয় হ’ল ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’। কেননা এটি সকল বস্ত্তর তাসবীহ এবং এর মাধ্যমেই সকল সৃষ্টিকে রূযী দেওয়া হয়। আর আমি তোমাকে নিষেধ করে যাচ্ছি দু’টি বস্ত্ত থেকে : শিরক ও অহংকার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলা হ’ল, আমরা সুন্দর জুতা পরি, সুন্দর পোষাক পরিধান করি, লোকেরা আমাদের কাছে এসে বসে- এগুলি কি অহংকার হবে? তিনি বললেন, না। বরং অহংকার হ’ল, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে হেয় জ্ঞান করা।[32]

সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও নিজের ভুলের উপর যিদ ও হঠকারিতার বিষয়টি বেশী দেখা যায় শিরক-বিদ‘আত ও তাকলীদপন্থী লোকদের মধ্যে, দল ও রাষ্ট্র নেতাদের মধ্যে এবং মূর্খ ও ধর্মান্ধ লোকদের মধ্যে। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই গর্বিত থাকে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজেকে সংশোধনের আকাংখা তাদের মধ্যে তেমন দেখা যায় না। বংশের নেতারা বড়াই করেন তাদের আভিজাত্য নিয়ে। নারীরা অহংকার করে তাদের সৌন্দর্য নিয়ে, ধনীরা অহংকার করে তাদের ধন নিয়ে, আলেমরা অহংকার করেন তাদের ইলম ও অনুসারী দল নিয়ে, দলনেতারা অহংকার করেন তাদের দল নিয়ে, রাষ্ট্রনেতারা অহংকার করেন তাদের শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে। অথচ সব অহংকারই ধূলায় মিশে যাবে আল্লাহর একটি ‘কুন’ শব্দে। অতএব হে মানুষ! অহংকারী হয়ো না, বিনয়ী হও। উদ্ধত হয়ো না, কৃতজ্ঞ হও। অতীত ভুলো না, সামনে তাকাও। জন্মের আগে তুমি কিছুই ছিলে না, এখুনি অচল বা পাগল হয়ে গেলে তুমি হিসাবযোগ্য কিছুই থাকবে না। অতএব অহংকার করো না।


[1]. কথিত আছে যে, নবুঅত দাবী করার কারণে তিনি ‘মুতানাববী’ নামে পরিচিত হন।

[2]. ইবনু খাল্লিকান, অফিয়াতুল আ‘ইয়ান ১/৪৫০ পৃঃ।

[3]. ইবনু হাযম, আল-ইহকাম (কায়রো : দারুল হাদীছ ১৪২৬/২০০৫) ৪/৫৮৪।

[4]. মুহাম্মাদ বিন আলাবী, মালেক বিন আনাস (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ ২০১০ খৃঃ) পৃঃ ৩২।

[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কেঈন ১/৭৬।

[6]. ঐ, ১/৩৩।

[7]. ঐ ১/৭৫।

[8]. মুসলিম হা/১৯০৫, মিশকাত হা/২০৫।

[9]. তিরমিযী হা/৩১৩৮ হাদীছ ছহীহ; মিশকাত হা/২২৫ ‘ইলম’ অধ্যায়।

[10]. আহমাদ, আবুদাঊদ হা/৩৬৬৪, ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/২২৭।

[11]. তিরমিযী হা/২৬৮৫, আবুদাঊদ হা/৩৬৪১, মিশকাত হা/২১২-২১৩।

[12]. ইবনু মাজাহ হা/২৩২, তিরমিযী হা/২৬৫৭, দারেমী হা/২৩০, মিশকাত হা/২৩০-৩১।

[13]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ ১৪৭ পৃঃ।

[14]. বুখারী হা/৭১৩৮, মুসলিম হা/১৮২৯; মিশকাত হা/৩৬৮৫।

[15]. মুসলিম হা/১৪২ ‘ঈমান’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৩৬৮৬।

[16]. মুসলিম হা/১৭৩৮, মিশকাত হা/৩৭২৭।

[17]. মুসলিম হা/২৮৬৫; মিশকাত হা/৪৮৯৮ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ‘পরস্পরে গর্ব’ অনুচ্ছেদ।

[18]. তিরমিযী হা/৩২৭০; আবুদাঊদ হা/৫১১৬; মিশকাত হা/৪৮৯৯।

[19]. বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭।

[20]. বুখারী হা/৫০৯০, মুসলিম হা/১৪৬৬, মিশকাত হা/৩০৮২ ‘বিবাহ’ অধ্যায়।

[21]. আহমাদ হা/১২৩২৯, ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৫৮, বুখারী হা/৭১৩৯, ফাৎহুল বারী, উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ, ইরওয়াউল গালীল হা/৫২০।

[22]. বুখারী হা/৩০৪২, মুসলিম হা/১৭৭৬, মিশকাত হা/৪৮৯৫।

[23]. তিরমিযী হা/৩৯৫৫, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৮৯৯।

[24]. বুখারী হা/৪৬৮৯, মুসলিম হা/২৩৭৮, মিশকাত হা/৪৮৯৩।

[25]. বুখারী হা/৩৩৯০; তিরমিযী হা/৩৩৩২; মিশকাত হা/৪৮৯৪।

[26]. বুখারী হা/৩৭৫৪।

[27]. সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪১৩।

[28]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩২২; তিরমিযী, আহমাদ, মিশকাত হা/১৩২৬ ‘ঐচ্ছিক ছালাত’ অনুচ্ছেদ।

[29]. খাত্ত্বাবী, আল-উযলাহ (কায়রো : মাতবা‘আ সালাফিয়াহ, ২য় সংস্করণ ১৩৯৯ হিঃ) ৮৯ পৃঃ।

[30]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৮২৫২।

[31]. ইবনুল জাওযী, ছাইদুল খাত্বের (দামেশক: দারুল কলম, ১ম সংস্করণ ২০০৪ খৃঃ) ২৯৫ পৃঃ।

[32]. আহমাদ হা/৬৫৮৩; ছহীহাহ হা/১৩৪।