হিংসা ও অহংকার

অহংকার

إِنَّ الَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوْا عَنْهَا لاَ تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلاَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِيْنَ-

‘নিশ্চয়ই যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা থেকে অহংকারবশে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাদের জন্য আকাশের দুয়ার সমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না ছুঁচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে। এভাবেই আমরা পাপীদের বদলা দিয়ে থাকি’ (আ‘রাফ ৭/৪০)।

অত্র আয়াতে আল্লাহ কুফরী বশে বা অজ্ঞতা বশে বলেননি, বরং ‘অহংকার বশে’ বলেছেন। ফলে অহংকারী কাফেরের জান্নাতে প্রবেশ করা ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ ছুঁচের ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ অসম্ভব। কাফের তওবা করে ঈমান আনতে পারে, অজ্ঞ ব্যক্তি জানার পরে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু অহংকারী ব্যক্তি স্বীয় অহংকারের উপর অটল থাকে ও এক সময় সে ধ্বংস হয়ে যায়। অহংকার তাই মারাত্মক পাপ। যা সাধারণতঃ হিংসার পরেই আসে এবং যা অধিকাংশ পাপের উৎস। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ মানুষকে অহংকারের পাপ ও তার ভয়াবহ পরিণতি বিষয়ে সাবধান করেছেন।

‘অহংকার’ মানব স্বভাবের একটি নিকৃষ্ট অংশ। বিশুদ্ধ-অশুদ্ধ সকল আক্বীদা-বিশ্বাসের লোকের মধ্যেই থাকে। এর উপকারিতার চেয়ে অনিষ্টকারিতা বেশী। একে দমন করে সৎকর্মে লাগানোর মধ্যেই মানুষের কৃতিত্ব নির্ভর করে। মানুষের মধ্যে ষড়রিপু হ’ল কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। এর মধ্যে ‘মদ’ হ’ল দম্ভ, গর্ব, অহংকার। ‘মাৎসর্য’ হ’ল ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা। প্রতিটি রিপুই মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্ট এবং প্রতিটির দক্ষ ব্যবহার কাম্য। যেমন টক-ঝাল-মিষ্টি-লবণ প্রতিটিই খাদ্যের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু অধিক বা অন্যায় ব্যবহারে প্রতিটিই ক্ষতিকর। জীবনে চলার পথে ষড়রিপু আমাদের সার্বক্ষণিক সাথী। এগুলি ডাক্তারের আলমারিতে সাজানো ‘পয়জন’ (Poison)-এর শিশির মত। যা তিনি প্রয়োজন মত রোগীর প্রতি ব্যবহার করেন। অথবা মটর গাড়ীর ইঞ্জিনে রাখা আগুনের বাক্সের মত। যাকে সর্বদা পাখা দিয়ে বাতাস করা হয় এবং ড্রাইভার সর্বদা গিয়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ীর গতি কমবেশী করে থাকেন। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত উপরোক্ত ৬টি আগুনের মধ্যে ‘মদ’ বা অহংকার হ’ল অন্যতম প্রধান স্ফুলিঙ্গ। যা একবার জ্বলে উঠলে ও নিয়ন্ত্রণ হারালে পুরা মানব গাড়ীটাকে পুড়িয়ে বা ধ্বংস করে ছাড়ে।

অহংকারের আরবী নাম ‘কিব্র’ (الْكِبْر)। যার অর্থ বড়ত্ব। অন্যের চাইতে নিজেকে বড় মনে করাই এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য। এর পারিভাষিক অর্থ, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। নিম্নের হাদীছটিতে এর পরিণতি ও ব্যাখ্যা দু’টিই বর্ণিত হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,

لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ. قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً. قَالَ : إِنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ، الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ-

‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তার পোষাক সুন্দর হৌক, তার জুতা জোড়া সুন্দর হৌক। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। কিন্তু ‘অহংকার’ হ’ল ‘সত্যকে দম্ভের সাথে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’।[1]

এর অর্থ এটা নয় যে, অহংকার করলেই সে জাহান্নামে যাবে। বরং এর অর্থ হ’ল সত্য জেনেও মিথ্যার উপরে যিদ করা এবং নানা অজুহাতে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা। আর ‘অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’ অর্থ হ’ল সর্বদা নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় মনে করা এবং অন্যের কাছে সর্বদা নিজের উচ্চ মূল্যায়ন কামনা করা। ফলে তার চাহিদা মতে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়াতেই সে অন্যকে হেয় জ্ঞান করে।

আবু ওয়াহাব আল-মারওয়াযী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারককে প্রশ্ন করলাম ‘অহংকার’ (الْكِبْر) কাকে বলে? তিনি বললেন, মানুষকে হেয় জ্ঞান করা। পুনরায় প্রশ্ন করলাম, ‘আত্মম্ভরিতা’ (العُجْب) কাকে বলে? তিনি বললেন, তোমার কাছে যা আছে, অন্যের কাছে তা নেই বলে ধারণা করা।[2] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনটি নাজাত দানকারী ও তিনটি ধ্বংসকারী বস্ত্ত থেকে মানুষকে সাবধান করেছেন। নাজাত দানকারী তিনটি বস্ত্ত হল, (১) গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা। (২) খুশীতে ও অখুশীতে সত্য কথা বলা এবং (৩) সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতার মধ্যবর্তী অবস্থা বেছে নেওয়া। অতঃপর ধ্বংসকারী তিনটি বস্ত্ত হ’ল, (১) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া (২) লোভের দাস হওয়া এবং (৩) আত্ম অহংকারী হওয়া। তিনি বলেন, এটিই হ’ল সবচেয়ে মারাত্মক (وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ)[3]

শায়খুল ইসলাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,التَّكَبُّرُ شَرٌّ مِنَ الشِّرْكِ فَإِنَّ الْمُتَكَبِّرَ يَتَكَبَّرُ عَنْ عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى، وَالْمُشْرِكَ يَعْبُدُ اللهَ وَغَيْرَهُ. ‘অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্ব করে এবং সাথে অন্যেরও করে’।[4]

হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,أصُوْلُ الْخَطَايَا كُلِّهَا ثَلاَثَةٌ: الْكِبْرُ وَهُوَ الَّذِيْ أصَارَ إِبْلِيسَ إِلَى مَا أصاره، والْحِرْصُ وَهُوَ الَّذِي أخرجَ آدمَ من الْجنَّة، والْحَسَدُ وَهُوَ الَّذِي جرأ أحدَ بني آدمَ على أَخِيه، فَمَن وقِيَ شَرَّ هَذِه الثَّلاَثَة فقد وقى الشَّرَّ كلَّه- فالكفرُ من الْكِبْر والمعاصي من الْحِرْص وَالْبَغْيُ وَالظُّلمُ من الْحَسَد- সমস্ত পাপের উৎস হ’ল তিনটি।- (১) অহংকার, যা ইবলীসের পতন ঘটিয়েছিল। (২) লোভ, যা জান্নাত থেকে আদম-কে বের করে দিয়েছিল। (৩) হিংসা, যা আদম (আঃ)-এর এক সন্তানের বিরুদ্ধে অপর সন্তানকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিল। যে ব্যক্তি উক্ত তিনটি বস্ত্তর অনিষ্ট হ‘তে বেঁচে থাকতে পারবে সে যাবতীয় অনিষ্ট হ‘তে বাঁচতে পারবে। কেননা কুফরীর মূল উৎস হ’ল ‘অহংকার’। পাপকর্মের উৎস হ’ল ‘লোভ’। আর বিদ্রোহ ও সীমালংঘনের উৎস হ’ল ‘হিংসা’।[5]

অহংকার ও আত্মম্ভরিতা দু’টিই বড়াই ও বড়ত্বের একক উৎস থেকে উৎসারিত। বস্ত্ততঃ এ রোগে যে আক্রান্ত হয়, সে নিজেকে নিজে ধ্বংস করে। তার দ্বারা  ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সংগঠন, এমনকি রাষ্ট্র ধ্বংস হয়।


[1]. মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৮ ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ।

[2]. সিয়ারু আ‘লামিল নুবালা ৮/৪০৭।

[3]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ); সনদ হাসান; মিশকাত হা/৫১২২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫০।

[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ৩য় প্রকাশ ১৯৯৬ খৃঃ) ২/৩১৬ পৃঃ।

[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৩৯৩/১৯৭৩) ৫৮ পৃঃ।