হাদীছের প্রামাণিকতা

হাদীছ-এর গুরুত্ব (أهمية الحديث)

১. ‘হাদীছ’ সরাসরি আল্লাহর ‘অহি’। কুরআন ‘অহিয়ে মাত্লু’ যা তেলাওয়াত করা হয়। কিন্তু হাদীছ ‘অহিয়ে গায়ের মাত্লু’ যা তেলাওয়াত করা হয় না। যেমন-

(ক) আল্লাহ বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى ، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى ‘রাসূল তাঁর ইচ্ছামত কিছু বলেন না। কেবলমাত্র অতটুকু বলেন, যতটুকু তাঁর নিকটে ‘অহি’ করা হয়’ (নাজম ৫৩/৩-৪)

(খ) তিনি অন্যত্র বলেন,

وَأَنْزَلَ اللهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا- ‘আল্লাহ আপনার উপরে নাযিল করেছেন কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) এবং আপনাকে শিখিয়েছেন, যা আপনি জানতেন না। আপনার উপরে আল্লাহর অনুগ্রহ অপরিসীম’ (নিসা ৪/১১৩)

(গ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

أَلاَ إِنِّى أُوتِيتُ الْقُرْآنَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ، أَلاَ يُوشِكُ رَجُلٌ شَبْعَانُ عَلَى أَرِيكَتِهِ يَقُولُ عَلَيْكُمْ بِهَذَا الْقُرْآنِ فَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَلاَلٍ فَأَحِلُّوهُ وَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَرَامٍ فَحَرِّمُوهُ وَإِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُوْلُ اللهِ كَمَا حَرَّمَ اللهُ... رواه أبو داؤدَ والترمذيُّ-

‘জেনে রাখো! আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি ও তার ন্যায় আরেকটি বস্ত্ত। সাবধান! এমন একটি সময় আসছে যখন বিলাসী মানুষ তার গদিতে বসে বলবে, তোমাদের জন্য এ কুরআনই যথেষ্ট। সেখানে যা হালাল পাবে, তাকেই হালাল জানবে এবং সেখানে যা হারাম পাবে, তাকেই হারাম জানবে। অথচ আল্লাহর রাসূল যা হারাম করেছেন তা আল্লাহ কর্তৃক হারাম করার অনুরূপ’।[1] এখানে ‘কুরআন’ হ’ল ‘প্রকাশ্য অহি’ এবং তার ন্যায় আরেকটি বস্ত্ত হ’ল ‘হাদীছ’ যা ‘অপ্রকাশ্য অহি’।[2] (ঘ) জিব্রীল (আঃ) সরাসরি নেমে এসে মানুষের বেশে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের মজলিসে বসে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ইসলাম, ঈমান, ইহসান প্রভৃতি বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন।[3]

২. হাদীছ হ’ল কুরআনের ব্যাখ্যা স্বরূপ। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ- ‘আমরা আপনার নিকটে ‘যিক্র’ নাযিল করেছি, যাতে আপনি লোকদের উদ্দেশ্যে নাযিলকৃত বিষয়গুলি তাদের নিকটে ব্যাখ্যা করে দেন এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহ্ল ১৬/৪৪)

৩. হাদীছের অনুসরণ ব্যতীত কেউ মুমিন হ’তে পারে না। যেমন আল্লাহ বলেন,

فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا- (النساء 65)-

‘আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা কখনোই মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়সমূহে আপনাকেই একমাত্র সমাধানকারী হিসাবে গ্রহণ করবে। অতঃপর আপনার দেওয়া ফায়ছালা সম্পর্কে তারা তাদের মনে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ পোষণ না করবে এবং অবনতচিত্তে তা গ্রহণ না করবে’ (নিসা ৪/৬৫)

৪. হাদীছের বিরোধিতা করার কোন এখতিয়ার মুমিনের নেই। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً مُبِينًا- (الأحزاب 36)-

‘কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর পক্ষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেওয়া ফায়ছালার ব্যাপারে (ভিন্নমত পোষণের) কোনরূপ এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করল, সে স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হ’ল’ (আহযাব ৩৩/৩৬)

৫. হাদীছ মেনে নেওয়া উম্মতের উপরে অপরিহার্য। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا، ‘আমার রাসূল  তোমাদেরকে যা প্রদান করেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)।

৬. হাদীছ অনুসরণের মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত। যেমন আল্লাহ বলেন,

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ - (آل عمران 31)-

‘আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ সমূহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়’ (আলে ইমরান ৩/৩১)। অত্র আয়াতে একথা স্পষ্ট যে, আল্লাহর ভালোবাসার সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য ও অনুসরণ শর্তযুক্ত। অতএব হাদীছের অনুসরণ ব্যতীত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব নয়।

৭. হাদীছের বিরোধিতা করা কুফরী। যেদিকে ঈঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,

قُلْ أَطِيعُوا اللهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ -

‘আপনি বলে দিন যে, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের। যদি তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে (তারা জেনে রাখুক যে,) আল্লাহ কখনোই কাফেরদের ভালবাসেন না’ (আলে ইমরান ৩/৩২)

৮. বিবাদীয় বিষয়ে কিতাব ও সুন্নাহর দিকেই ফিরে যেতে হবে, অন্যদিকে নয়। যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً- (النساء 59)- ‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে ঝগড়া কর, তাহ’লে তোমরা বিষয়টিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। সেটাই হবে উত্তম ও পরিণামের দিক দিয়ে সুন্দরতম’ (নিসা ৪/৫৯)।

৯. হাদীছের অনুসরণ অর্থ আল্লাহর অনুসরণ। যেমন আল্লাহ বলেন,

مَن يُّطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيْظًا-  ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল, আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিল, আমরা তাদের উপরে আপনাকে পাহারাদার হিসাবে প্রেরণ করিনি’ (নিসা ৪/৮০)

১০. হাদীছের বিরোধিতায় জাহান্নাম অবধারিত। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا (الجن 23)- ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করল, তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হ’ল। সেখানে সে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে’ (জিন্ন ৭২/২৩)।

১১. হাদীছের বিরোধিতা করলে দুনিয়া ও আখেরাতে ফিৎনায় পড়া অবশ্যম্ভাবী। যেমন আল্লাহ বলেন,فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ-  ‘যারা রাসূলের আদেশ-নিষেধের বিরোধিতা করে, তারা যেন এ বিষয়ে ভয় করে যে, তাদেরকে (দুনিয়াবী জীবনে) গ্রেফতার করবে নানাবিধ ফিৎনা এবং (পরকালীন জীবনে) গ্রেফতার করবে মর্মান্তিক আযাব’ (নূর ২৪/৬৩)।

১২. হাদীছের সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়া মুনাফিকের লক্ষণ। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَيَقُولُونَ آمَنَّا بِاللهِ وَبِالرَّسُولِ وَأَطَعْنَا ثُمَّ يَتَوَلَّى فَرِيقٌ مِنْهُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَمَا أُولَئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ - وَإِذَا دُعُوا إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيْقٌ مِنْهُمْ مُعْرِضُوْنَ- (النور ৪৭-৪৮)-

‘তারা বলে আমরা আল্লাহ ও রাসূলের উপরে ঈমান এনেছি ও তাঁর আনুগত্য করি। অতঃপর তাদের মধ্যকার একদল লোক পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। বস্ত্ততঃ তারা মুমিন নয়।’ ‘অনুরূপভাবে যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়ছালার দিকে আহবান করা হয়, তখন তাদের মধ্যকার একদল লোক মুখ ফিরিয়ে নেয় (নূর ২৪/৪৭-৪৮)। ‘অথচ মুমিনদের কথা এরূপ হওয়া উচিত যে, যখন তাদেরকে ফায়ছালার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হবে তখন তারা বলবে, আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১)।

(খ) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُوْلِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِيْنَ يَصُدُّوْنَ عَنْكَ صُدُوْدًا- (النساء 61)- ‘যখন তাদেরকে বলা হয় যে, তোমরা এস ঐ সত্যের দিকে, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং এস রাসূলের দিকে, তখন আপনি মুনাফিকদের দেখবেন যে, তারা আপনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে (বা আপনার নিকটে আসা থেকে লোকদের পথ রুদ্ধ করে দেবে)’ (নিসা ৪/৬১)

১৩. রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত তথা হাদীছের অনুসরণকে ওয়াজিব করে আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অন্যূন ৪০ জায়গায় বর্ণনা করেছেন।

১৪. ছাহাবায়ে কেরাম হাদীছকে আল্লাহ প্রেরিত ‘অহি’ হিসাবেই বিশ্বাস করতেন। যেমন আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন যে, একদা জনৈকা মহিলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! পুরুষেরা আপনার সব হাদীছ নিয়ে গেল। এক্ষণে আমাদেরকে আপনি নিজের থেকে একটা দিন নির্দিষ্ট করে দিন, যেদিন আমরা আপনার নিকটে আসব এবং আপনি আমাদেরকে শিখাবেন, যা আল্লাহ আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের জন্য একটা দিন ও স্থান নির্দিষ্ট করে দেন ও সেখানে আগমন করেন। অতঃপর তাদেরকে শিক্ষা দেন যা আল্লাহ তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন’।[4]

এখানে তিনটি বিষয় সাব্যস্ত হয় (১) রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় পুরুষ ও নারী সকলে হাদীছ শিক্ষাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতেন (২) পুরুষের ন্যায় মহিলাগণও রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে হাদীছ শিখতে আসতেন (৩) হাদীছকে তাঁরা সবাই আল্লাহর সরাসরি ‘অহি’ হিসাবে বিশ্বাস করতেন।

১৫. হাদীছের উপরে বিশ্বাস রাখা বা না রাখাই হ’ল মুমিন ও কাফিরের মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا فَقَدْ عَصَى اللهَ ، وَمُحَمَّدٌ فَرَقٌ بَيْنَ النَّاسِ ، رواه البخارىُّ- ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। মুহাম্মাদ হ’লেন লোকদের মধ্যে হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী মানদন্ড’।[5]

১৬. হাদীছ অমান্য করলে জাহান্নামী হ’তে হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ  إِلاَّ مَنْ أَبَى قِيْلَ وَمَنْ أَبَى؟ قَالَ : مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى ، رواه البخارىُّ-

‘আমার প্রত্যেক উম্মত জান্নাতে যাবে। কেবল তারা ব্যতীত, যারা অসম্মত হবে। জিজ্ঞেস করা হ’ল ‘অসম্মত’ কারা? তিনি বললেন, যারা আমার আনুগত্য করল, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং যারা আমার অবাধ্যতা করবে, তারাই হ’ল অসম্মত’।[6]

১৭. হারাম ও হালালের বিধান প্রদানে হাদীছের স্থান কুরআনের ন্যায়। বরং তার চেয়ে বেশী। যেমন গৃহপালিত গাধা, দন্ত-নখরওয়ালা হিংস্র পশু ও পক্ষী কুরআনে হারাম করা হয়নি, অথচ হাদীছে হারাম করা হয়েছে।[7] কুরআনে সকল মৃত এবং রক্তকে হারাম করা হয়েছে’ (বাক্বারাহ ২/১৭৩)। অথচ হাদীছে দু’প্রকার মৃত অর্থাৎ মাছ ও টিড্ডি পাখি[8] এবং দু’প্রকার রক্ত অর্থাৎ কলিজা ও প্লীহাকে হালাল করা হয়েছে।[9]

১৮. হাদীছ কেবল কুরআনের ব্যাখ্যাকারী নয়, বরং অনেক সময় কুরআনই হাদীছের প্রত্যয়নকারী।

যেমন (ক) হিজরতের পূর্বে মক্কায় ১২ নববী বর্ষে সংঘঠিত মি‘রাজের রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হয় এবং জিব্রীল (আঃ) এসে রাসূল (ছাঃ)-কে ওযূ ও ছালাতের নিয়ম-কানূন শিক্ষা দেন এবং তখন থেকেই ছাহাবায়ে কেরাম নিয়মিত ওযূসহ ছালাত আদায় করতে থাকেন। অথচ ওযূর ফরয পদ্ধতি সর্ম্পকে সূরা মায়েদাহর ৬ নং আয়াত নাযিল হয় মি‘রাজের ঘটনার ৮ বছর পরে ৬ষ্ঠ হিজরীতে মদীনায়। (খ) মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ) বলেন,  ইহুদীদের শনিবার ও নাছারাদের রবিবার সাপ্তাহিক উপাসনার দিনের বিপরীতে আনছার ছাহাবীগণ মদীনায় আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে শুক্রবার জুম‘আর ছালাত আদায় শুরু করেন এবং তাঁরাই সর্বপ্রথম ‘জুম‘আহ’ নামকরণ করেন। কেননা এদিনের পূর্বনাম ছিল ‘আরূবাহ’ (العروبة)। পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হিজরত করে এলে জুম‘আ ফরয হওয়ার আয়াত সম্বলিত সূরা জুম‘আ নাযিল হয়।[10]

তবে যেহেতু হাদীছের বিশাল ভান্ডারের সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণ কুরআনের ন্যায় ‘মুতাওয়াতির’ বা অবিরত ধারায় বর্ণিত ও সকলের নিকটে সমভাবে ও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়নি, সেকারণ বিদ্বানগণ হাদীছকে কুরআনের পরে দ্বিতীয় স্তরে রেখেছেন। তবে কুরআনের সংক্ষিপ্ত, অস্পষ্ট ও মৌলিক বিধান সমূহের বিপরীতে বিস্তারিত, সুস্পষ্ট এবং মৌলিক ও বিস্তৃত বিধানাবলী সম্বলিত হাদীছ শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা মুমিন জীবনে সর্বাধিক। যা ব্যতীত পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামী জীবন যাপন করা মুমিনের জন্য আদৌ সম্ভবপর নয়।

১৯. হাদীছের অনুসরণ ব্যতীত মুমিনের সকল নেক আমল বিফলে যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلاَ تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ- (محمد 33)- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমরা তোমাদের আমলসমূহকে বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)

২০. আক্বীদা ও আহকাম সকল বিষয়ে হাদীছ হ’ল চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী।

যেমন (১) কবর আযাব, ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণ ও ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে অবতরণ, মাহদীর আগমন, দাজ্জালের আবির্ভাব প্রভৃতি আক্বীদাগত বিষয় (২) ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ও হজ্জের নিয়ম-কানূন ইত্যাদি ইবাদতগত বিষয় (৩) ব্যবসা-বাণিজ্যসহ হালাল-হারামের অর্থনৈতিক বিধানসমূহ, স্ত্রীর সাথে তার বোন ও খালা-ফুফুকে বিবাহ না করা, রক্ত সম্পর্কীয়দের ন্যায় দুগ্ধ সম্পর্কীয়দের সাথে বিবাহের নিষিদ্ধতাসহ বিবাহ ও তালাকের বিস্তারিত নিয়ম ও বিধানসমূহ, পৌত্রের সম্পত্তিতে দাদীর উত্তরাধিকার, সামাজিক জীবনে আমীরের আনুগত্য, বিবাহিত ও  অবিবাহিত যেনাকারের শাস্তির পার্থক্য, মদ্যপান, অঙ্গচ্ছেদন ও ক্ষতিকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধের শাস্তিবিধানসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াবলীর বিস্তারিত বিধি-বিধান কেবলমাত্র হাদীছের মাধ্যমেই আমরা প্রাপ্ত হয়েছি। সেকারণ হাদীছের অনুসরণ ব্যতীত ইসলামের অনুসরণ কল্পনা করা অসম্ভব।


[1]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৬৩।

[2]. ড. মুহাম্মাদ আবু শাহবাহ, দিফা‘ ‘আনিস সুন্নাহ (কায়রো : মাকতাবাতুস সুন্নাহ ১৪০৯/১৯৮৯) পৃ: ১৫।

[3]. হাদীছে জিব্রীল, মুসলিম, মিশকাত হা/২।

[4]. বুখারী, মিশকাত হা/১৭৫৩; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৬৬১ ‘জানাযা’ অধ্যায় ‘মৃতের জন্য ক্রন্দন’ অনুচ্ছেদ।

[5]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৪ ‘কুরআন ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[6]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৩।

[7]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৩; মুসলিম, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪১০৫, ৪১০৬।

[8]. এক প্রকার ছোট মরুপক্ষী; যা সচরাচর আরবরা শিকার করে খেত।

[9]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ প্রভৃতি, মিশকাত হা/৪১৩২ ‘শিকার ও যবহ’ অধ্যায়, ‘যে সব বস্ত্ত খাওয়া হালাল ও হারাম’।

[10]. তাফসীর কুরতুবী ১৮/৯৮ সূরা জুম‘আ ৯ আয়াতের ব্যাখ্যা।