হাদীছের প্রামাণিকতা

হাদীছ বিরোধীদের যুক্তিসমূহ (أدلة منكري الحديث)

১. কুরআন সকল বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করেছে। যেমন আল্লাহ বলেছেন, مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ‘আমরা কিতাবে কোন কিছু ছাড়িনি’ (আন‘আম ৬/৩৮)। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ ‘আর আমরা আপনার উপরে কুরআন নাযিল করেছি (মানুষের প্রয়োজনীয়) সকল বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা হিসাবে’ (নাহল ১৬/৮৯)। অতএব হাদীছের প্রয়োজন নেই (যাওয়াবে‘ পৃঃ ৩১৯)

প্রথম আয়াতের ‘কিতাব’ অর্থ হ’ল, ‘লওহে মাহফূয’। যেখানে আল্লাহ মানুষের দ্বীন-দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সকল বিষয় লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, কিছুই ছাড়েননি বা লিখতে ভুলেন নি।

দ্বিতীয় আয়াতের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যাই হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ২৩ বছরের দীর্ঘ নবুঅতী জীবন। যাঁর কথা, কর্ম ও সম্মতি সমূহ ‘হাদীছ’ হিসাবে উম্মতের নিকট মওজুদ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا ‘আমার রাসূল তোমাদের যা প্রদান করেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও’ (হাশর ৫৯/৭)। এখানে ‘প্রদান করেন’ অর্থ ‘আদেশ করেন’ (ইবনু কাছীর)। যেমন ‘আব্দুল ক্বায়েস’ গোত্রের প্রতিনিধি দল রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এলে তিনি তাদেরকে চারটি বিষয়ে আদেশ করেন ও চারটি বিষয় নিষিদ্ধ করেন। অতঃপর তিনি উক্ত আয়াতটি পাঠ করেন।[1] অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَمَا نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ فَاجْتَنِبُوْهُ ‘যখন আমি তোমাদের কোন বিষয়ে আদেশ দেই, তখন তোমরা তা সাধ্যমত পালন কর। আর যখন কোন বিষয়ে নিষেধ করি, তখন তা থেকে বিরত হও’।[2]

একদা আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হাদীছ শুনালেন, لَعَنَ اللهُ الْوَاشِمَاتِ وَالْمُوتَشِمَاتِ وَالْمُتَنَمِّصَاتِ وَالْمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ الْمُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللهِ ‘আল্লাহ লা‘নত করেছেন ঐ সমস্ত নারীর প্রতি যারা অন্যের শরীরে উল্কি অংকন করে, নিজ শরীরে উল্কি অংকন করায়, যারা সৌন্দর্যের জন্য ভ্রুর চুল উপড়ে ফেলে ও দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে। যে সব নারী আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি আনয়ন করে।’ একথা বনু আসাদের জনৈকা মহিলা উম্মে ইয়াকূবের নিকট পেঁŠছলে তিনি ইবনু মাসঊদের নিকটে এসে বললেন, আপনি কি এরূপ কথা বলেছেন? ইবনু মাসঊদ বললেন, আমি কেন তাকে লা‘নত করব না, যাকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) লা‘নত করেছেন এবং যা আল্লাহর কিতাবে রয়েছে? তখন মহিলাটি বলল, আমার কাছে রক্ষিত কুরআনের কোথাও একথা পাইনি। জবাবে ইবনু মাসঊদ বললেন, যদি তুমি কুরআন ভালভাবে পড়, তাহ’লে পাবে। তুমি কি দেখনি আল্লাহ বলেছেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ... ‘আমার রাসূল তোমাদের যা আদেশ করেন, তা গ্রহণ কর ... (হাশর ৫৯/৭)। তখন মহিলাটি বলল, হাঁ। ইবনু মাসঊদ বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে উক্ত কাজে নিষেধ করেছেন’। তখন মহিলাটি বলল, আমার ধারণা আপনার পরিবারে এরূপ আছে। ইবনু মাসঊদ বললেন, যাও দেখে আসো। মহিলাটি ভিতরে গিয়ে তেমন কিছু না পেয়ে ফিরে এল। তখন ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বললেন, যদি এরূপ থাকত, তাহ’লে তুমি আমাদের দু’জনকে (স্বামী-স্ত্রীকে) একত্রে পেতে না (অর্থাৎ তালাক হয়ে যেত)’।[3]

মোটকথা সুন্নাহর মাধ্যমেই কুরআন تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْئٍ ‘সকল বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা’ হয়েছে। অতএব হাদীছ ব্যতীত কুরআন অনুসরণ করা সম্ভব নয়।

২. কুরআন আল্লাহ সহজ করেছেন। অতএব হাদীছের প্রয়োজন নেই। যেমন আল্লাহ বলেছেন, وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ ‘আমরা কুরআনকে সহজ করেছি উপদেশ লাভের জন্য। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? (ক্বামার ৫৪/১৭, ২২, ৩২, ৪০)

উত্তর : এখানে কুরআন সহজ হওয়ার অর্থ হ’ল, এর শিক্ষা-দীক্ষা সহজ-সরল ও বাস্তবায়নযোগ্য। যেমন ছালাত কায়েম কর, যাকাত দাও, ছিয়াম রাখ, হজ্জ কর। পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। অন্যায় ও অশ্লীলতা হ’তে দূরে থাক ইত্যাদি। এগুলি যেকোন কুরআন পাঠক সহজে বুঝতে পারেন। কিন্তু কুরআন অনুধাবনের অর্থ তা নয়। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ- ‘এই কিতাব যা আমরা আপনার নিকট নাযিল করেছি, তা বরকতমন্ডিত। তা এজন্য নাযিল করেছি যাতে লোকেরা এর আয়াতসমূহ গবেষণা করে এবং জ্ঞানীরা এ থেকে উপদেশ হাছিল করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)। তিনি জ্ঞানীদের তিরষ্কার করে বলেন, أَفَلاَ يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوْبٍ أَقْفَالُهَا؟ ‘কেন তারা কুরআন গবেষণা করেনা? নাকি তাদের হৃদয় সমূহ তালাবদ্ধ?’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)। কুরআন গবেষণা ও তার মর্ম অনুধাবন ও সেখান থেকে বিধি-বিধান নির্ধারণ ও উপদেশ আহরণের জন্য প্রয়োজন কুরআনের ভাষা ও অলংকার জ্ঞানে পরিপক্কতা অর্জন করা ও অন্যান্য যরূরী বিষয়াদিতে দক্ষতা লাভ করা। বস্ত্ততঃ কুরআনের প্রথম ব্যাখ্যাতা হ’লেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। অতঃপর ছাহাবায়ে কেরাম, যাদের কাছে তিনি কুরআন বর্ণনা করেছেন, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, বিধানসমূহ বাস্তবায়ন করেছেন ও উপদেশ প্রদান করেছেন। যা লিপিবদ্ধ আছে ‘হাদীছ’ ও ‘আছারে’। অতএব হাদীছ ব্যতীত কুরআন অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

৩. আল্লাহ কেবল কুরআন হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন, হাদীছের নয়।

উত্তর : আল্লাহ বলেছেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ‘আমরা যিকর নাযিল করেছি এবং আমরাই এর হেফাযতকারী’ (হিজর ১৫/৯)। এখানে ‘যিকর’ অর্থ যেমন ‘কুরআন’ তেমনি ‘হাদীছ’। বরং পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শরী‘আতের হেফাযতকারী হ’লেন আল্লাহ। কেননা ইসলাম হ’ল পূর্ণাঙ্গ দ্বীন এবং তা মানবজাতির জন্য আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম (মায়েদাহ ৫/৩)। অতএব শত্রুরা যতই চক্রান্ত করুক, একে ধ্বংস করার ক্ষমতা কারু নেই। আল্লাহ এর হেফাযতকারী। অতএব ‘যিকর’ কেবলমাত্র কুরআন নয়, বরং হাদীছ সহ পূর্ণাঙ্গ শরী‘আত। আল্লাহ বলেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ ‘অতএব তোমরা জিজ্ঞেস কর জ্ঞানীদের যদি তোমরা না জানো’ (নাহল ১৬/৪৩)। এখানে ‘আহলুয যিকর’ অর্থ আল্লাহর দ্বীনে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, لاَ تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ (16) إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ (17) فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ (18) ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ (19) ‘আপনি ‘অহি’ আয়ত্ব করার জন্য দ্রুত জিহবা সঞ্চালন করবেন না’। ‘নিশ্চয়ই তা সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমাদের’। ‘অতএব যখন আমরা (জিব্রীলের মাধ্যমে) তা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন’। ‘অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমাদেরই’(ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯)। এখানে ‘বিশদ ব্যাখ্যা’ অর্থ ‘হাদীছ’, যা অহি ও ইলহামের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর নবীকে প্রদান করেছেন। অতএব কুরআন ও হাদীছ দু’টিরই হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহর।

ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, শরী‘আত অভিজ্ঞ বিদ্বানগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই যে, আল্লাহ প্রেরিত সকল ‘অহি’ যিকরের অন্তর্ভুক্ত এবং সকল ‘অহি’ সংরক্ষিত। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ যা হেফাযত করে থাকেন। আর আল্লাহ যার হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন, তা সকল প্রকার ক্ষতি হ’তে নিরাপদ এবং যা চিরকালের জন্য সকল প্রকার তাহরীফ বা পরিবর্তন ও বাতিলকরণ হ’তে মুক্ত।’ তিনি বলেন, ‘যারা যিকর অর্থ স্রেফ ‘কুরআন’ বলেন, তাদের এ দাবী মিথ্যা ও প্রমাণহীন। বরং কুরআন ও সুন্নাহ সবটাই ‘অহি’ এবং সবটাই যিকরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন, وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ ‘আর আমরা আপনার প্রতি ‘যিকর’ নাযিল করেছি মানুষকে ব্যাখ্যা করে দেওয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে। যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহল ১৬/৪৪)

বস্ত্ততঃ রাসূল (ছাঃ) প্রদত্ত ব্যাখ্যা ও তাঁর প্রদর্শিত পথই হ’ল ‘সুন্নাহ’ বা ‘হাদীছ’ যা ছাহাবায়ে কেরামের স্মৃতি ও লেখনীর মাধ্যমে চিরকালের জন্য কুরআনের ন্যায় সংরক্ষিত হয়ে আছে।


[1]. নাসাঈ হা/৫৬৪৩ ‘পানীয়’ অধ্যায় ৩৬ অনুচ্ছেদ; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৭।

[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫০৫, ‘মানাসিক’ অধ্যায়-১০।

[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৪৩১, ‘পোষাক’ অধ্যায়-২২, ‘চুল অাঁচড়ানো’ অনুচ্ছেদ-৩।