গল্পের মাধ্যমে জ্ঞান

সময় মানুষের মধ্যে আবর্তিত হয়

বহুদিন আগের কথা। এক দেশে ছিল এক জমিদার। ধন-ঐশ্বর্য, অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তার কোন জুড়ি ছিল না। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত, রামাযানের ছিয়াম পালন, ধন-মালের যাকাত প্রদান সহ ইসলামের বুনিয়াদী ফরয সমূহ তিনি যথাযথভাবে আদায় করতেন। সকাল-সন্ধ্যায় কুরআন তেলাওয়াত ছিল তার নিত্য-নৈমিত্তিক অভ্যাস। একদিন সকালে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতকালে নিম্নোক্ত আয়াতের প্রতি তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়-وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ ‘আর আমি এ দিনগুলোকে মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি’ (আলে ইমরান ১৪০)। তিনি আয়াতের ব্যাখ্যা জানার জন্য মসজিদের ইমাম ছাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন। ইমাম ছাহেব অল্পকথায় এভাবে ব্যাখ্যা দিলেন যে, ‘কোন কোন সময় ধনী মানুষ নিঃস্ব-দরিদ্র হয়, আবার কখনো দরিদ্র ব্যক্তি বিশাল সম্পদের মালিক হয়’। কিন্তু জমিদার এই ব্যাখ্যা মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারলেন না। কারণ বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষ থেকে তাদের জমিদারী বহাল আছে, এরতো কোন পরিবর্তন হয়নি! কোন অবনতি তো দূরের কথা, দিন দিন জায়গা-জমি, ধন-সম্পদ বেড়েই  চলেছে। শত বিঘা জমির উপর বিশাল বাড়ি, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু, আস্তাবলে ঘোড়া, সিন্দুক ভরা সোনা-চাঁদির বিশাল মজুদ, আছে হিরা-জহরত সহ মহামূল্যবান রত্ন। কোন আয়-উপার্জন না করে কোন লোক হাযার বছর ধরে বসে খেলেও তা নিঃশেষ হওয়ার নয়। সুতরাং এ সম্পদ কি নিমিষেই শেষ হয়ে একেবারে পথের ভিখেরী হওয়া সম্ভব? না, বিশ্বাস হয় না জমিদারের। প্রকারান্তরে তিনি আয়াতটি কিছুটা অস্বীকার করেন। মনে মনে ভাবেন, এটা কি করে সম্ভব?

ইবাদত-বন্দেগীতে যথেষ্ট আন্তরিক হ’লেও জমিদারের মনে কিছুটা অহংকার ছিল। কিছুটা বদ মেজাযীও ছিলেন তিনি। আবার কাজে-কর্মে ছিলেন একরোখা ও ভীষণ জেদি। যা করতে চাইতেন তা করে ফেলতেন। এজন্য তার কর্মচারী-কর্মকর্তারা যেমন তাকে যারপরনাই ভয় করত, তেমনি পরিবারের সদস্যরাও তার জন্য ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত। কারো কথায় বা পরামর্শে তিনি চলতেন না, নিজে যা বুঝতেন তাই করতেন। অনেকটা স্বৈরাচারী স্বভাবের লোক ছিলেন তিনি। লঘুদন্ডে কাউকে গুরু শাস্তি প্রদান, আবার মহা অপরাধেও কাউকে ক্ষমা করে দিতেন সম্পূর্ণ নিজের খেয়াল-খুশিমত। ফলে তার দ্বারা অনেক সময় নিরপরাধ ও নির্দোষ মানুষও নির্যাতনের শিকার হ’ত।

একদা তার এক ছেলে তীর-ধনুক নিয়ে খেলছিল। এক দরিদ্র বৃদ্ধার একটি ছাগলের গায়ে তার নিক্ষিপ্ত তীর বিদ্ধ হয়ে ছাগলটি তৎক্ষণাৎ মারা যায়। বৃদ্ধা বিচারপ্রার্থী হয়ে জমিদারের দরবারে আসে। জমিদার ছেলেকে ডেকে ঘটনা জিজ্ঞেস করেন। ছেলে উল্টো অভিযোগ করে যে, খোলা মাঠে এভাবে ছাগল না থাকলে তো মরতো না। জমিদার ছেলের কথায় সায় দিয়ে বৃদ্ধার ছাগলের মূল্য না দিয়ে খোলা মাঠে ছাগল ছেড়ে দেয়ার অপরাধে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। বৃদ্ধা আল্লাহর কাছে দো‘আ করে, আল্লাহ! তুমি এর বিচার করো!

একবার জমিদারের নায়েবের ছেলে ও জমিদারের ছেলের মধ্যে ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় নায়েবের ছেলে বিজয়ী হয়। পক্ষান্তরে জমিদারের ছেলে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়। সুস্থ হয়ে সে নায়েবের ছেলেকে বেদম প্রহার করে এবং তার ঘোড়াটাকেও মেরে ফেলে। নায়েব জমিদারের কাছে বিচার দিলে তিনি তার কোন বিচার না করে উল্টো নায়েবকে বলেন, আমার ছেলের বিরুদ্ধে আমার কাছে বিচার দিতে তোমার একটুও বাঁধল না। আমার খেয়ে, আমার পরে আমার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ? একটু মেরেছে তো কি হয়েছে? মরেতো যায়নি! চিকিৎসা করাও ভাল হয়ে যাবে। নায়েব একবুক ব্যথা নিয়ে অতিকষ্টে বাড়ি ফিরে আসে। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেটে দো‘আ করে, আল্লাহ! তুমিই ন্যায়বিচারক। এই যুলুমের সুষ্ঠু বিচার তোমার কাছে প্রত্যাশা করছি। তুমি এর বিচার করো!

জমিদারের ছিল শিকারের প্রবল নেশা। তিনি একদিন ঘটা করে তার লোকজন নিয়ে গভীর অরণ্যে শিকারের উদ্দেশ্যে যান। ৪/৫ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও তেমন কোন শিকারের সন্ধান না পেয়ে বনের আরো গভীরে চলে যান। পথিমধ্যে শুরু হয় প্রচন্ড ঝড়। জমিদার তার লোকজন থেকে আলাদা হয়ে পড়েন। এক একজন একেক দিকে ছুটে যায় প্রাণ বাঁচাতে। ফলে কারো সাথে কারো কোন যোগাযোগ থাকে না। সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জমিদারও দৌড়াতে দৌড়াতে অন্য রাজার দেশে চলে যান। ঘটনাক্রমে ঐদিন রাজার বাড়িতে ডাকাতি হয়। খোয়া যায় অনেক মূল্যবান জিনিস।

এদিকে রাজ্যের পাইক-পেয়াদা, সৈন্য-সামন্ত ডাকাত দলের খোঁজে প্রতিটি এলাকা ও বন-বাদাড় তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে তারা ঐ জমিদারকে বনের এক পাশে পেয়ে তাকেই ধরে নিয়ে যায়। গায়ের পোশাক-পরিচ্ছদ দামী হ’লেও তাতে ময়লা-আবর্জনা লেগে আছে। উষ্কখুষ্ক চুল, বিবর্ণ চেহারা। মুখে আভিজাত্যের ছাপ থাকলেও অন্ধকারে তা কেউ খেয়াল করেনি। তাকেই ডাকাত মনে করে ধরে নিয়ে যায়। ফেলে রাখে কয়েদখানায়। পরদিন সকালে রাজা ডাকাত বলে ধৃত জমিদারকে দেখতে আসেন। তাকে দেখে রাজার মনে ধাক্কা লাগে- এতো ডাকাত হ’তে পারে না? ঘুমিয়ে ছিল বলে তাকে রাজা ডাকতে নিষেধ করেন। ঘুম ভাঙ্গলে জমিদার ওযূর পানি চান। তিনি ওযূ করে ছালাত আদায় করে ভাবতে থাকেন- আমি এখানে কেন? তিনি আস্তে আস্তে মনে করতে থাকেন। শুধু তাঁর মনে পড়ে যে, তিনি শিকারে বের হয়েছিলেন এবং ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন। তারপর আর তার কিছু মনে নেই।

জমিদার রক্ষীদের প্রশ্ন করে জানতে পারেন যে, তাকে ডাকাত হিসাবে ধরে আনা হয়েছে। তিনি তখন রাজার সাথে দেখা করতে চান। রাজার দরবারে তাকে আনা হ’লে তিনি ঘটনা খুলে বললেন। আর রক্ষীর কাছে তার ছালাত আদায়ের কথা শুনে রাজা ভাবলেন এ লোক ডাকাত হ’তে পারে না। রাজা তাকে ছেড়ে দেন। এদিকে জমিদার বাড়ি এসে দেখে তার বাড়ির অধিকাংশ নদীভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে, বাসভবন ধসে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আর কেউ বেঁচে নেই। ধন-ভান্ডারও নদীগর্ভে বিলীন। নায়েব, পাইক, পেয়াদা কে কোথায় আছে কারো হদিস নেই। জমিদার মসজিদে গিয়ে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে নিজের অতীত-বর্তমানের কথা ভাবছেন। ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ে কুরআনের ঐ আয়াতের কথা। জমিদার কেঁদে কেটে আল্লাহর নিকট তওবা করেন। নিজের ভুলের জন্য, কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চান।

শিক্ষা : ক্ষমতার মোহে অনেক সময় মানুষ স্ফীত হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। সে মনে করে, তার ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি কখনোই নষ্ট হবে না। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের মালিক একমাত্র আল্লাহ।