গল্পের মাধ্যমে জ্ঞান

তাক্বওয়ার পুরস্কার

আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে লক্ষ্য করে বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْ- ‘হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর’ (নিসা ৪/১)। অন্যত্র তিনি ঈমানদারগণকে লক্ষ্য করে বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوْتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর। আর তোমরা অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না’ (আলে ইমরান ৩/১০২)। আল্লাহ পাক আরো বলেন, وَتَعَاوَنُواْ عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُواْ عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ- ‘তোমরা পুণ্যের কাজে ও আল্লাহভীতিতে একে অপরকে সাহায্য কর এবং পাপ কাজে ও সীমালংঘনে পরস্পরকে সাহায্য করো না, আর আল্লাহ্কে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর’ (মায়েদাহ ৫/২)

এ সম্পর্কিত উপদেশমূলক একটি ঘটনা, সিরিয়ার বিখ্যাত আলেমে দ্বীন শায়খ ত্বানতাভী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটা এই যে, একটি ছেলে নেক ও সৎ স্বভাবের ছিল। তার মধ্যে তাক্বওয়া (আল্লাহভীতি) ও পরহেযগারিতা ছিল। বিদ্যার্জনের প্রতি তার খুব একটা স্পৃহা ছিল না। সে একটা মাদরাসায় পড়ত। সে শিক্ষকের নির্দেশ মোতাবেক চলত। জ্ঞানার্জনের শেষ পর্যায়ে একদিন তার উস্তাদ তাকে এবং তার সহপাঠীদেরকে নছীহত করলেন, জীবনে কখনো মানুষের মুখাপেক্ষী হবে না। কারণ মানুষের সামনে হাত পেতে ধরা আলেম কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। এজন্য যে, দাতারা যা কিছু বলবে এবং যা কিছু করবে দানগ্রহীতা আলেম তার কোন প্রতিবাদ করতে পারে না। কারণ সে তাদের অনুগ্রহের ভিখারী হয়ে পড়ে। অতএব তোমরা ফিরে গিয়ে নিজ নিজ পিতার পেশা অবলম্বন করে জীবিকার্জন করবে। আর যেকোন কাজে আল্লাহকে ভয় করবে ও তাক্বওয়া অবলম্বন করবে।

শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাড়ী ফিরে গেল। ঐ ছেলেটিও বাড়ী গিয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা আমার বাবার পেশা কি ছিল? ছেলের এই প্রশ্নে মা হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং বললেন, বেটা বহুদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে তোমার বাবা ইন্তিকাল করেছেন। তোমার বাবার পেশার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? এতদিন পরে তুমি আমাকে এ কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? ছেলে তার বাবার পেশা জানার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। আর তার মা টালবাহানা করতে থাকলেন। ছেলের পীড়াপীড়িতে এক পর্যায়ে মা ছেলের পিতার পেশা বলতে বাধ্য হ’লেন। তিনি বললেন, তোমার আববার কোন ভাল পেশা হ’লে তা বলতে আমার এত দ্বিধা হ’ত না। তোমার পীড়াপীড়িতে বলতে হচ্ছে, তোমার আববার পেশা ছিল চৌর্যবৃত্তি। ছেলে তার মায়ের উত্তর শুনে বলল, আম্মা! আমার উস্তাদ সকল ছাত্রকে বলেছেন, তোমরা তোমাদের পিতার পেশা অবলম্বন কর। আর সব কাজে তাক্বওয়ার খেয়াল রেখো। মা বললেন, চুরি করতে তাক্বওয়া অবলম্বন! এ কেমন কথা? ছেলে বলল, আম্মা! উস্তাদ এই কথাই বলেছেন।

অতঃপর ছেলেটি চুরি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন করতে শুরু করল। যথারীতি প্রশিক্ষণ নিল। সে প্রয়োজনীয় উপকরণও সংগ্রহ করল। প্রশিক্ষণ শেষে সে চিন্তা-ভাবনা করে কাজের পরিকল্পনা তৈরী করল। একদিন এশার ছালাত আদায় করার পর লোকজনের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা করতে লাগল। লোকজন যখন ঘুমিয়ে পড়ল, চতুর্দিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল, তখন সে প্রথমে প্রতিবেশীর ঘরেই চুরি আরম্ভ করার সংকল্প করল। সে প্রতিবেশীর বাড়ীতে প্রবেশ করতে গেলে উস্তাদের নছীহত তার স্মরণ হ’ল। সে মনে মনে বলতে লাগল, প্রতিবেশীর ঘরে চুরি করা ও তাকে কষ্ট দেওয়া তো তাক্বওয়া বিরোধী কাজ। এতে আল্লাহ তা‘আলা অসন্তুষ্ট হবেন। সুতরাং সে প্রতিবেশীর ঘর ছেড়ে অন্য ঘরের দিকে অগ্রসর হ’ল। সেটা ছিল এক ইয়াতীম-অনাথের ঘর। এর ঘরে চুরি করাও তাক্বওয়াবিরোধী কাজ। কারণ আল্লাহ তা‘আলা ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন। ফলে সে এ ঘর ছেড়ে অন্য ঘরের দিকে অগ্রসর হ’ল। এইভাবে যখনই সে কোন ঘরের কাছে আসে এবং চুরি করার ইচ্ছা করে তখনই কিছু না কিছু ভাবনা তার মনে উদয় হয়, অতঃপর তা তাক্বওয়াবিরোধী কাজ ভেবে আরও অগ্রসর হ’তে থাকে। এভাবে সে একটা ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল। এটা জনৈক ব্যবসায়ীর ঘর। সে একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তার একটা মাত্র কন্যা সন্তান। মনে মনে বলল, হ্যাঁ, এই ঘরে চুরি করা চলে। অতঃপর চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করে দেখল এতে অনেকগুলি কক্ষ রয়েছে। সে ঐ বিশাল ঘরে ঘুরতে লাগল। যেন সে চোর নয়; বরং কোন মেহমান। শেষে তার দৃষ্টি পড়ল একটা সিন্দুকের উপর। সেটা খুলে দেখল তা সোনা-চাঁদি, টাকা-পয়সায় পরিপূর্ণ। সে সিন্দুক থেকে মাল-ধন বের করার ইচ্ছা করল। কিন্তু তার উস্তাদের উপদেশ মনে পড়ল। মনে মনে বলতে লাগল, প্রথমতঃ এই ব্যবসায়ী তার মালের যাকাত দিয়েছে কি-না, তা জানা নেই। সর্বাগ্রে তার যাকাতের হিসাব পর্যালোচনা করা যাক। সুতরাং সে হিসাব সংক্রান্ত খাতাপত্র বের করে সঙ্গে আনা ছোট লণ্ঠনটি জ্বেলে নিল এবং তার আলোতে খাতাপত্রগুলি তন্ন তন্ন করে দেখতে লাগল। সে হিসাব-কিতাবে বেশ অভিজ্ঞ ছিল। সে দ্রুত সম্পদের পূর্ণ হিসাব করে ফেলল এবং  যাকাতের অংশ বের করে পৃথক রাখল।

হিসাব-নিকাশে সে এমনভাবে ডুবে গিয়েছিল যে, সময়ের কোন খেয়াল ছিল না। হঠাৎ মনে হ’ল ফজরের সময় হয়ে গেছে। সে নিজের মনেই বলল, তাক্বওয়ার চাহিদা হচ্ছে প্রথমে ফজরের ছালাত সমাপন, তারপর কাজ। সে ঘর থেকে বের হয়ে আঙ্গিনায় এসে ওযূ করল। তারপর ছালাতের জন্য ইক্বামত দিল। ঘরের মালিক ইক্বামত শুনে ঘাবড়ে গিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল ছোট একটি লণ্ঠন টিপ টিপ করে জ্বলছে। সিন্দুক খোলা এবং তার সম্মুখে এক তরুণ ছালাত আদায় করার জন্য ইক্বামত দিচ্ছে। ঘরের গৃহীনীও জেগে গেছে। সে এইসব দেখে স্বামীকে জিজ্ঞেস করছে, ওখানে কি হচ্ছে? গৃহকর্তা বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। অতঃপর সে দোতলা থেকে নেমে ঐ তরুণের কাছে গিয়ে বলল, তুমি কে? আর তুমি করছই বা কি? চোর ছেলেটি বলল,  প্রথমে ছালাত, পরে কথা। ঘরের মালিক যথেষ্ট ঘাবড়ে গিয়েছিল। তরুণ তাকে বলল, আপনি শীঘ্র ওযূ করে আসুন। সে ওযূ করে এলো। তরুণ বলল, আপনি ছালাতে ইমামতি করুন। সে তরুণকে বলল, না, বরং তুমি ইমামতি কর। তরুণ বলল, আপনি এই ঘরের মালিক। আপনিই ইমামতি করার বেশী হক্বদার। সে এসব চিন্তাই করতে পারেনি। সে নিজের জানমাল নিয়ে শঙ্কিত। কোন রকমে ছালাত শেষ করল। ভয় ও শঙ্কায় তার মনের অবস্থা ভাল ছিল না। ছালাত শেষ হ’লে মালিক বলল, এখন বল তুমি কে? এখানে কি উদ্দেশ্যে এসেছ? আমার সিন্দুক খোলা কেন? তরুণ বলল, আমি চোর, চুরি করার জন্য এসেছি। কিন্তু আপনি বলুন, যাকাত আদায় করেন না কেন? আমি আপনার খাতাপত্রগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি। আপনি ছয় বছর থেকে যাকাত আদায় করেননি। এটা আল্লাহর হক্ব, যা ফরয। আমি হিসাব করে দিয়েছি এবং যাকাতের মাল পৃথক করে রেখেছি। যাতে আপনি যাকাতের হক্বদার ব্যক্তিদেরকে পৌঁছে দিতে পারেন। এসব কথা শুনে গৃহস্বামী স্তম্ভিত হয়ে গেল। তুমি এসব কি করেছ? তুমি কি পাগল? সে বলল, আমি পাগল নই, সম্পূর্ণ সুস্থ-সবল ও জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি। গৃহকর্তা বলল, তাহ’লে তুমি চুরি করছ কেন? উত্তরে ছেলেটা সম্পূর্ণ কাহিনী ব্যবসায়ীকে শুনাল।

ব্যবসায়ী ছেলেটির সহজ-সরল সুদর্শন চেহারা এবং হিসাব-নিকাশে তার দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়ে স্বীয় স্ত্রীর কাছে গেল এবং তরুণ চোর সম্পর্কে সব বৃত্তান্ত খুলে বলল। অতঃপর সে বলল, তুমি তোমার একমাত্র কন্যার বিবাহের জন্য পেরেশান ছিলে। আল্লাহ তা‘আলা তোমার ঘরে পাত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। সবকিছু শুনে স্ত্রীও একমত পোষণ করল।

অতঃপর সে তরুণ ছেলেটার নিকটে এসে বলল, দেখ চুরি করা খুব জঘন্য কাজ। তোমার ধন-সম্পদ দরকার হ’লে এবং তুমি চাইলে আমি তোমাকে আমার সম্পদের অংশীদার করতে পারি। তরুণ বলল, সেটা কিভাবে? ব্যবসায়ী বলতে লাগল, আমার একটি মাত্র কন্যা। আমি তার বিবাহ তোমার সঙ্গে দিতে চাই। আমি তোমাকে আমার সম্পদের প্রধান হিসাব রক্ষক নিয়োগ করতেও প্রস্ত্তত আছি। তোমাকে বাসস্থান ও প্রয়োজনীয় অর্থ আমি প্রদান করব। তুমি তোমার মার সঙ্গে পরামর্শ করে নাও।

তরুণ ছেলেটি এই প্রস্তাবে তার সম্মতি প্রকাশ করল। সে তার মাকে বলতেই তিনি রাযী হ’লেন। পরবর্তীতে দিন ধার্য করে ব্যবসায়ী ঐ তরুণের সঙ্গে তার কন্যার বিবাহ দিলেন।

শিক্ষা : তাক্বওয়াশীল মানুষকে আল্লাহ তার তাক্বওয়ার মাধ্যমেই হেদায়াত দান করেন এবং বিনিময়ে অঢেল পুরস্কার প্রদান করেন।