গল্পের মাধ্যমে জ্ঞান

কুরআনের ইলাহী সংরক্ষণ ও একজন ইহুদী পন্ডিতের ইসলাম গ্রহণ

আববাসীয় খলীফা মামূনুর রশীদের দরবারে মাঝে মাঝে শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হ’ত। এতে তৎকালীন বিভিন্ন বিষয়ের বিদগ্ধ পন্ডিতগণ অংশগ্রহণ করতেন। একদিন এমনি এক আলোচনা সভায় সুন্দর চেহারাধারী, সুগন্ধযুক্ত উত্তম পোষাক পরিহিত জনৈক ইহুদী পন্ডিত আগমন করলেন এবং অত্যন্ত প্রাঞ্জল, অলংকারপূর্ণ এবং জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রাখলেন। বিস্মিত খলীফা সভা শেষে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ইহুদী? তিনি স্বীকার করলেন। মামূন তাকে বললেন, আপনি যদি মুসলমান হয়ে যান তবে আপনার প্রতি সুন্দরতম আচরণ করা হবে। তিনি উত্তরে বললেন, পৈতৃক ধর্ম বিসর্জন দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই বলে তিনি প্রস্থান করলেন।

কিন্তু এক বছর পর তিনি মুসলমান হয়ে আবার দরবারে আগমন করলেন এবং আলোচনা সভায় ইসলামী ফিক্বহ সম্পর্কে সারগর্ভ ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। সভা শেষে মামূন তাকে ডেকে বললেন, আপনি কি ঐ ব্যক্তি নন, যিনি গত বছর এসেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ আমিই ঐ ব্যক্তি। মামূন জিজ্ঞেস করলেন, তখন তো আপনি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। এখন মুসলমান হওয়ার কারণ কি?

তিনি বললেন, এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর আমি সমকালীন বিভিন্ন ধর্মগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার মনস্থ করি। আমি একজন সুন্দর লিপিকার। স্বহস্তে গ্রন্থাদি লিখে উঁচু দামে বিক্রয় করি। তাই পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাওরাতের তিনটি কপি লিপিবদ্ধ করলাম এবং এগুলির অনেক জায়গায় নিজের পক্ষ থেকে কিছু কমবেশী করে লিখলাম। অতঃপর কপিগুলো নিয়ে আমি ইহুদীদের উপাসনালয়ে উপস্থিত হ’লাম। তারা অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে আমার কপিগুলো কিনে নিল। অতঃপর একইভাবে ইঞ্জীলের তিন কপি করলাম এবং তাতে কমবেশী করে লিখে খৃষ্টানদের গীর্জায় নিয়ে গেলাম। সেখানেও তারা খুব আগ্রহভরে কপিগুলো ক্রয় করে নিল। এরপর আমি কুরআনের ক্ষেত্রেও একই কাজ করলাম এবং এতেও কম-বেশী করে লিখলাম এবং বিক্রয়ের জন্য নিয়ে গেলাম। কিন্তু ক্রয়কারীকে দেখলাম, সে প্রথমে আমার লেখা কপিটি নির্ভুল কি না যাচাই করে দেখল। অতঃপর সেখানে কমবেশী দেখতে পেয়ে ক্রয় না করে কপিগুলো ফেরত দিল। 

এ ঘটনা দর্শনে আমি এ শিক্ষাই গ্রহণ করলাম যে, নিশ্চয়ই এ গ্রন্থ সংরক্ষিত, আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং এর সংরক্ষক। আর এই উপলব্ধিই আমার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।

এই ঘটনা বর্ণনাকারী কাযী ইয়াহ্ইয়া বিন আকছাম বলেন, ঘটনাক্রমে সে বছরই আমার হজ্জব্রত পালন করার সৌভাগ্য হয়। সেখানে প্রখ্যাত আলেম সুফিয়ান ইবনে উয়ায়নার সাথে সাক্ষাত হ’লে ঘটনাটি আমি তার নিকটে ব্যক্ত করলাম। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে এরূপ হওয়াই যথার্থ। কারণ কুরআনেই তো এ চিরন্তন সত্যের সমর্থনে আয়াত রয়েছে। তিনি বললেন, কোথায় রয়েছে? সুফিয়ান বললেন, কুরআনে যেখানে তাওরাত ও ইঞ্জীলের আলোচনা এসেছে, সেখানে এসেছে, بِمَا اسْتُحْفِظُوْا مِنْ كِتَابِ الله  وَكانُوْا عَلَيْهِ شُهَداءَ ‘তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের হেফাযতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং তারা এ ব্যাপারে সাক্ষী ছিল’ (মায়েদা ৫/৪৪)। অতঃপর যখন তারা দায়িত্ব পালন করেনি তখন গ্রন্থদ্বয় বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়ে বিনষ্ট হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে কুরআনের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ ‘আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক’ (হিজর ১৫/৯)। আল্লাহ নিজেই আমাদের জন্য কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেন ফলে তা বিনষ্ট হয়নি (আল-মুনতাযাম ১০/৫১; কুরতুবী ১০/৫; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/৩৮৮)

শিক্ষা : অন্যান্য আসমানী গ্রন্থসমূহ কালের বিবর্তনে বিকৃত হয়ে গেলেও কুরআন রয়ে গেছে সম্পূর্ণ অবিকৃত। এটা কুরআনের অন্যতম মু‘জিযা।