একটি পত্রের জওয়াব

ইছলামী জামাআত বনাম আহলেহাদীছ আন্দোলন[1]

                         - মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোরায়শী

ইছলামী জামাআত  (জামায়াতে ইছলামী) সম্পর্কে অনেক দিন হইতে আমরা পুনঃপুনঃ জিজ্ঞাসিত হইয়া আসিতেছি। অনিবার্য কারণ ব্যতীত কাহারও সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া আমাদের রীতি বিরুদ্ধ বলিয়া উল্লিখিত দল সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে কিছু বলা এ যাবত আমরা সমীচীন মনে করি নাই, কিন্তু সম্প্রতি সাধারণ মুছলিম উলামা সমাজ বিশেষতঃ আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে ইছলামী জামাআতের ইমামে- আ’যম হইতে আরম্ভ করিয়া নিতান্ত অনুল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরাও যে ভাবগতিক দেখাইতেছেন, তজ্জন্য কয়েকটি কথা ব্যক্ত করা অবশ্য- কর্তব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

ফির্কা ও আন্দোলনের পার্থক্য

দল অর্থাৎ ফির্কা এবং আন্দোলনের মধ্যভাগে যে বৈষম্য সুস্পষ্ট সীমারেখা টানিয়া দিয়াছে তাহার মোটামুটি বিবরণ এই যে, দলের আদর্শ এবং কার্যসূচী কোন ব্যক্তিত্বকে আশ্রয় ও নির্ভর করিয়াই উদ্ভাবিত এবং রূপায়িত হইয়া থাকে। ফির্কাবন্দীর ভিতর ব্যক্তিত্বের কেন্দ্রত্ব এরূপ অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় যে, আদর্শের নিষ্ঠা ও কার্যক্রমের অনুসরণের দিক দিয়া কোন ব্যক্তি যতই অগ্রণী হউক না কেন, ফির্কার নেতার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আনুগত্যপরায়ণ না হওয়া পর্যন্ত তাহার নিষ্ঠা ও কর্মতৎপরতার কোন মূল্যই স্বীকৃত হয় না। পক্ষান্তরে আদর্শবাদ ও কর্মপরায়ণতা অপেক্ষা ফির্কাবন্দীর ভিতর দলীয় নেতার আনুগত্য ও অন্ধ অনুসরণই অধিকতর মূল্যবান বিবেচিত হইয়া থাকে। কালক্রমে এরূপও দেখিতে পাওয়া যায় যে, দলপতির ভ্রম প্রমাদগুলিরও ফির্কাপরস্তের দল একান্ত শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠাসহকারে অনুসরণ করিয়া চলিয়াছে, মূল আদর্শ ও কর্মসূচীর সহিত দলপতির ব্যক্তিগত উক্তি ও আচরণের ব্যতিক্রম সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও অন্ধ ভক্তরা তাহাদের নেতার উক্তি ও আচরণকেই অগ্রগণ্য করিতেছে। পরিণামে ফির্কাবন্দীতে আদর্শ ও কর্মের সমুদয় ঝঞ্ঝাট বিদূরিত হইয়া দলীয় অহমিকতা ও ফির্কাপরস্তীর আত্মম্ভরিতাই সমুদয় স্থান জুড়িয়া বসে।

আহলেহাদীছ ফির্কা বা দল নয়

একথা কাহাকেও বলিয়া দিতে হইবেনা যে, এই উম্মতের মধ্যে কোন ব্যক্তি বিশেষকে আশ্রয় ও অবলম্বন করিয়া আহলেহাদীছ আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপিত হয় নাই। উম্মতের অন্তরভুক্ত কোন ব্যক্তিরই নিজস্ব দৃষ্টিভংগী ও উদ্ভাবিত কর্ম পদ্ধতিকে আহলেহাদীছগণ তাঁহাদের দলীয় আকীদা এবং কর্মসূচী রূপে গ্রহণ করেন নাই। ফকীহ ও মুহাদ্দিছগণ দূরের কথা, ওলী, গাওছ, কুতুব পরের কথা, ছাহাবা ও তাবেয়ীগণের মধ্যেও কোন মহান ব্যক্তিকে আহলেহাদীছগণ অভ্রান্ত ও মাছুম স্বীকার করিয়া লইয়া তাঁহাদের কোন ব্যক্তি বিশেষকে নির্ধারিত নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেন নাই, সুতরাং এক নিঃশ্বাসে যাহারা অন্যান্য দল ও ফির্কার সহিত আহলেহাদীছ আন্দোলনের নামও উচ্চারণ করিয়া থাকেন, তাহারা হয় এই আন্দোলনের পটভূমিকা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, অথবা সংকীর্ণতার বশবর্তী হইয়াই তাঁহারা আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই স্পষ্ট নিদর্শনটিকে উপেক্ষা করিয়া চলেন।

অন্যান্য মযহবের সহিত আহলেহাদীছগণের পার্থক্য

কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, কোরআন ও হাদীছের একচ্ছত্র অধিনায়কত্ব প্রতিপন্ন ও প্রতিষ্ঠা করা কি একমাত্র আহলেহাদীছ আন্দোলনেরই বৈশিষ্ট? আমরা সসম্মানে আরয করিব- জ্বী হাঁ! আহলে ছুন্নতের অন্তরভুক্ত সমুদয় ফির্কাই নীতিগতভাবে হাদীছের প্রামাণিকতা ও প্রাধান্য স্বীকার করিয়া লইলেও দুইটি বিশেষ কারণে তাঁহাদের নির্দিষ্ট নেতা ও ইমামগণের সিদ্ধান্তই কার্যতঃ তাঁহাদের নিকট প্রামাণিকতার মৌলিক স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছে। প্রথমতঃ তাঁহাদের নেতাদের কোন উক্তি হাদীছের পরিপন্থী হইলে তাঁহারা হাদীছের পরোক্ষ ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন বটে, কিন্তু একটি স্থানেও তাঁহারা তাঁহাদের ইমামগণের সিদ্ধান্ত বর্জন করিয়া রছূলুল্লাহর (দঃ) হাদীছের অনুসরণ করিতে সাহসী হননা। দ্বিতীয়তঃ তাঁহাদের নেতাগণের পরিগৃহীত কোন রেওয়ায়ত তহ্কীক ক্ষেত্রে দুর্বল বা অপ্রামাণ্য সাব্যস্ত হইলেও তাহারা উহা পরিত্যাগ করিয়া তদপেক্ষা প্রামাণ্য ও বলিষ্ঠ রেওয়ায়ত অবলম্বন করেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে নেতাগণের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকেই ভিত্তি করিয়া তাঁহারা ‘উপমান’ পদ্ধতির সাহায্যে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রতিপাদন করিয়া থাকেন।

কিন্তু আহলেহাদীছগণ মতবাদ ও আচরণের দিক দিয়া রছূলুল্লাহর (দঃ) হাদীছকে চুল পরিমাণও অতিক্রম করিয়া যাইতে প্রস্ত্তত নহেন। বিশুদ্ধ হাদীছের সমকক্ষতায়, উহার বিপরীত যে কোন মহাবিদ্বান ও বিরাট পুরুষের উক্তি হউক না কেন, তাঁহারা উহা মানিতে স্বীকৃত নহেন। কোন দুর্বল হাদীছকে বলিষ্ঠতর হাদীছের মুকাবিলায় গ্রহণ করিতে তাঁহারা কদাচ রাযী নহেন। ইহার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই যে, সকল ফির্কাই স্ব স্ব ময্হবের মছ্আলাগুলি বিশেষভাবে সংকলিত করিয়া গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। তাঁহারা নিজেদের দলীয় মছ্আলার পুস্তকগুলিকে নিজেদের গ্রন্থ এবং অপর দলের মছ্আলার পুস্তকগুলিকে ভিন্ন ময্হবের কিতাব বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। কিন্তু আহলেহাদীছ বিদ্বানগণ রছূলুল্লাহর (দঃ) হাদীছের চয়ন, সংকলন, সম্পাদন, ব্যাখ্যা ও আলোচনা ব্যতীত নিজেদের ময্হবের স্বতন্ত্র কোন কিতাব রচনা করেন নাই।

আহলেহাদীছ আন্দোলনের পরিচয়

আমাদের এই উক্তিগুলি যাঁহারা নিরপেক্ষ মনে বিচার করিতে সমর্থ, তাঁহারা ইহা স্বীকার করিয়া লইতে বাধ্য হইবেন যে, আহলেহাদীছ কোন নির্দিষ্ট দল বা ফির্কার নাম নয়, বরং তাঁহারা ফির্কাপরস্তী এবং দলবন্দীর নিরোধ করিতে এবং সমগ্র মুসলিম জাতিকে এক ও অভিন্ন কেন্দ্রে সমাবেশিত করিতে আত্মনিয়োগ করিয়াছেন। কিন্তু কোরআন ও হাদীছের সার্বভৌম প্রতিষ্ঠা এবং জাতির পুনর্গঠন ও সংস্কারের কার্য এরূপ সুদূর প্রসারী ও বিভাগ বহুল যে, আহলেহাদীছগণের সকলেই নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে চলিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারেন নাই। তাঁহাদেরই একদল এই দেশে লেখনীর সাহায্যে কোরআন ও ছুন্নতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা এবং দার্শনিক তত্ত্ব সম্বলিত সহস্র সহস্র গ্রন্থ ও সাহিত্য রচনা করিয়াছেন। মাত্র অল্প কিছুদিন পূর্বেও জনৈক আহলেহাদীছ মহাবিদ্বান আল্লামা ছৈয়েদ ছিদ্দীক হাছান (রহঃ) একাই ক্ষুদ্র বৃহৎ পাঁচ শতাধিক গ্রন্থ[2] রচনা করিয়াছিলেন। ভারতের ইতিহাসে এরূপ গ্রন্থকারের দৃষ্টান্ত মুগল রাজত্বকালেও সুলভ নয়।

ইহাদেরই আর একটি দল তাঁহাদের সমস্ত জীবন শুধু কোরআন ও হাদীছের অধ্যাপনা কার্যে উৎসর্গ করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের সাধনার ফলেই হিন্দ ও বাংলার ঘরে ঘরে রছূলুল্লাহর (দঃ) হাদীছের পবিত্র প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। এই আহলেহাদীছগণেরই এক দল শির্ক ও বিদ্আতের প্রতিরোধকল্পে এবং তওহীদ ও ছুন্নতের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কান্দাহার হইতে সিংহল পর্যন্ত এবং নেপালের তরাই হইতে আরম্ভ করিয়া সুন্দরবন পর্যন্ত পথে পথে ঘুরিয়া কে কোন্স্থানে যে মৃত্যুবরণ করিয়াছেন তাহার বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করা দুঃসাধ্য। আহলেহাদীছগণেরই আর একটি দল পারিবারিক জীবনের মায়া এবং সুখ-শান্তি পরিহার করিয়া নিষ্কাশিত তরবারী হস্তে ভারতের সীমান্তে দীর্ঘকাল যাবত সক্রিয় জিহাদে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। শুধু এইগুলিই নয়, শতাব্দীর ঊর্ধকাল যাবত পাক-ভারতের যে কোন স্থানে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক যত প্রকার আন্দোলন জন্মপরিগ্রহ করিয়াছে, ‘ন্যায়ের সাহচর্য এবং অন্যায়ের অসহযোগ’ নীতির অনুসরণ করিয়া আহলেহাদীছগণ সেগুলির প্রত্যেকটিতেই যোগদান করিয়াছিলেন।

যতদিন চন্দ্র-সূর্য বিদ্যমান থাকিবে, যতদিন কোরআন ও হাদীছের বিজয় বৈজয়ন্তী উড্ডীন থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত আহলেহাদীছ আন্দোলনের অস্তিত্ব ধরাপৃষ্ঠে জীবন্ত-জাগ্রত রহিবেই। নদীর স্রোত যেরূপ সকল ঋতুতেই খরতর থাকে না, তেমনি আহলেহাদীছ আন্দোলনের স্রোতে কোন কোন সময় ভাটা দর্শন করিয়া এই আন্দোলনের পতন ও মৃত্যুর ধারণা পোষণ করা মূর্খজনোচিত ধারণা মাত্র।

ইছলামী জামাআতের স্বরূপ

আহলেহাদীছ আন্দোলন যে দিক দিশারী মশাল প্রজ্জ্বলিত করিয়াছে, তাহারই আলোক আহরণ করিয়া পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ও এই উপমহাদেশে বহু সভামন্ডপ আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে। এই আন্দোলনের ভাবাদর্শের আংশিক অনুকরণ করিয়াই ‘‘ইছ্লামী জামাআত’’ পাক ভারত উপমহাদেশে কোরআন ও হাদীছের সার্বভৌমত্ব ও ইছলামী জীবন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার কথা বারংবার উচ্চারণ করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আহলেহাদীছ আন্দোলনের রুচি ও প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত তাঁহারা একটি স্বতন্ত্র ফির্কাবন্দীর গোড়াপত্তন করিয়াছেন। দলীয় অহমিকতা, ফির্কাবন্দীর দাম্ভিকতা এবং অন্ধ গতানুগতিকতা পূর্ণভাবেই এই ফির্কাটিকে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে। তাঁহারা একথা ভুলিয়া গিয়াছেন যে, পৃথিবীর সত্তর কোটি মুছলমান যত মতে এবং পথেই বিভক্ত হইয়া থাকুক না কেন, একমাত্র ইসলামই তাঁহাদের সর্বসম্মত সম্পদ এবং মিলনকেন্দ্র। ইসলামের মহাসাগর তীর্থেই সকল ভেদ ও বৈষম্যকে জলাঞ্জলী দিয়া মুছলমানগণ একাত্মা হইয়াছেন আর এই জন্যই কোন দলই ইসলামে এক-চেটিয়া অধিকারী বলিয়া দাবী করার স্পর্ধা কোন কালেই প্রকাশ করেন নাই। কিন্তু এই তথাকথিত ‘ইছ্লামী জামাআতের’ স্পর্ধা যে, যে মানুষটিকে কেন্দ্র করিয়া তাঁহাদের এ ফির্কা গজাইয়া উঠিয়াছে, কেবল সেইটিই হইতেছে ‘ইছ্লামী জামাআত’। এরূপ অভিমানের নযীর ইসলামের ধর্মীয় আন্দোলনের ইতিহাস হইতে খুঁজিয়া বাহির করা দুঃসাধ্য।

অবশ্য ইছলামের বিভিন্ন দল ও ফির্কাসমূহের পরস্পর অসমঞ্জস ও বিরোধী মতবাদসমূহের জগাখিচুড়ী প্রস্ত্তত করিয়া যদি ইছলামী জামাআতের নামে একটি ফ্রন্ট রচনা করা হইত, তাহা হইলেও হয়ত এই নামের স্বার্থকতা আংশিকভাবে প্রতিপন্ন হইতে পারিত, কিন্তু কার্যতঃ আমরা দেখিতে পাইতেছি যে, মওলানা ছৈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী নামক ব্যক্তি এবং তাঁহার নিকট দীক্ষিত কতিপয় বিদ্বান ও অবিদ্বানের অভিমত ও উক্তিগুলিই ইছলামী জামাআতের সিদ্ধান্ত নামে কথিত হইয়াছে। তাঁহাদের আমীরে আ’লার ‘তজ্দীদে দ্বীন’ শীর্ষক নিবন্ধে পূর্বেও প্রদর্শিত হইয়াছিল যে, ইছলামের প্রাথমিক যুগ হইতে আজ পর্যন্ত ‘সমগ্র ইছলামের’ উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠাদানের আন্দোলন কোন ইমাম, মুজ্তাহিদ, ফকীহ, মুহাদ্দিছ, ওলী, সাধক, রাষ্ট্রপতি ও মুজাদ্দিদ কেহই সৃষ্টি করিতে পারেন নাই। ইসলামের তেরশত বৎসরের ইতিহাসে সামগ্রিকভাবে ইসলামকে বুঝিবার ও বুঝাইবার উপযোগী যোগ্যতা ও ত্যাগের মহিমা একমাত্র তথাকথিত ইছলামী জামাআতের নেতারাই অর্জন করিয়াছেন।

এই ফির্কার ইমামে আ’যম তাঁহার দীর্ঘ কারাবাস হইতে মুক্ত হইয়া সম্প্রতি শেখুপুরায় যে বক্তৃতা প্রদান করিয়াছেন, তাহাতেও  তাঁহার সেই পুরাতন দাম্ভিকতার প্রতিধ্বনি সমানভাবেই বিঘোষিত হইয়াছে। তিনি বলিতে চাহিয়াছেন, ধর্মের এবং জাতির সেবার কার্য তাঁহার দলটি ব্যতীত অন্য কোন সংঘ[3], পার্টি বা সমাজ কিছু মাত্র সমাধা করেন নাই। জম্ঈয়তে উলামাও নয়। আহরারও নয়, আহলেহাদীছরা তো একদমই নয়। তাঁহার এই দাম্ভিকতার অনস্বীকার্য প্রমাণস্বরূপ তিনি বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, একমাত্র তাঁহারাই সরকারী কোপে পতিত হইয়াছেন। লাঞ্ছনা ও কারাবাসকে প্রোপাগান্ডার বিষয়বস্ত্তরূপে প্রয়োগ করা ইছলামী আদর্শের সহিত কতদূর সুসমঞ্জস এবং এই বিবৃতির সত্যতাই বা কতটুকু, তাহার আলোচনা না করিলেও কার্য ও কারণের মধ্যে যে গভীর যোগাযোগের সন্ধান মওলানা ছৈয়েদ আবুল আ’লা প্রাপ্ত হইয়াছেন, ন্যায় শাস্ত্রের ছাত্রগণ তাহা উপলব্ধি করিয়া যে চমৎকৃত হইবেন, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। 

‘ইছলামী জামাআতের’ লেখক এবং নেতৃবৃন্দের অহমিকতা এইখানেই সমাপ্ত হয় নাই। মওলানা ছৈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী বারংবার বিনা কারণে এই ধৃষ্ট উক্তিও ঘোষণা করিয়া বেড়াইতেছেন যে, ইছলাম- জগতে কোরআনের পরবর্তী সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ ও মাননীয় গ্রন্থ ছহীহ বুখারী প্রমাদবিহীন পুস্তক নয়।  এযাবত তিনি বুখারীর কোন সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করেন নাই অথবা উক্ত গ্রন্থে তিনি যে সকল প্রমাদের সন্ধান লাভ করিয়াছেন, উল্লেখ সহকারে সেগুলির প্রমাণ প্রদর্শন করিতেও সক্ষম হন নাই।

সর্বোপরি বর্তমান সময়ে যখন কোরআন ও ছুন্নতের প্রামাণিকতা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে হাদীছ বৈরীগণ নানারূপ সন্দেহ ও দ্বিধার জাল বুনিতে চেষ্টা করিতেছে, ঠিক সেই অবাঞ্ছিত মুহূর্তে মওলানা মওদুদী ছাহেবের ছহীহ বুখারীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গারের হেতুবাদ কি?

তাঁহার ‘রাছায়েল ও মাছায়েল’ পুস্তকে তিনি একথা বলিতে দ্বিধা বোধ করেন নাই যে, নমাযে রুকূতে যাওয়া ও রুকূ হইতে মস্তক উত্তোলন করার সময়ে হস্তোত্তোলন করা বা না করা, আমীন যোরে উচ্চারণ করা বা না করা কোন নির্দিষ্ট দলের আচার এবং চিহ্নে পরিণত হইলে এবং উক্ত কার্যসমূহের বর্জন ও গ্রহণের উপর কোন  দলের অন্তরভুক্ত বা বহির্ভূত হওয়া নির্ভর করিলে উল্লিখিত আচরণগুলি অর্থাৎ হস্তোত্তোলন করা বা না করা, আমীন যোরে বা আস্তে বলা সর্বাপেক্ষা জঘন্য বিদ্আত হইবে। যাঁহারা হস্তোত্তোলন করিয়া থাকেন, তাহাদের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য বিচার করার অধিকার মওলানা ছৈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী কোথায় প্রাপ্ত হইলেন? তাঁহার এই উক্তি দ্বারা তিনি তাঁহার অন্তর্নিহিত ‘‘আহলেহাদীছ বিদ্বেষ’’কেই প্রকটিত করেন নাই কি? এই রূপ এই দলটি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নমায বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত বার তাকবীরের বিরুদ্ধেও তাঁহাদের মুখপত্র সমূহে যে কঠোর সমালোচনা করিয়াছেন, তাহাতেও তাঁহাদের আহলেহাদীছ বিদ্বেষ সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয় নাই কি?

মওলানা মওদুদী ছাহেব আহলে ছুন্নতগণের অন্যতম অধিনায়ক ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের একখানা পত্র পাঠ করার সুযোগ কখনও পাইয়াছেন কি? যাহাতে তিনি মুছদ্দদকে লিখিয়াছিলেন, ‘‘আহলে ছুন্নতগণের কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ রহিয়াছে, তন্মধ্যে প্রথমটি হইতেছে, নমাযে              ‘‘রফ্এ ইয়াদায়েন’’ করার কার্যকে পূণ্যবর্ধক মনে করা। দ্বিতীয়: ইমামের ‘‘ওয়ালায্যাল্লীন’’ বলার পর উচ্চৈঃস্বরে আমীন উচ্চারণ করা, তৃতীয়: মৃত আহলে কিবলা নমাযীর জানাযা পড়া, চতুর্থ: ভালমন্দ প্রত্যেক নেতার সংগে জিহাদের জন্য উত্থান করা, পঞ্চম: প্রত্যেক ধর্মপরায়ণ অথবা দুশ্চরিত্র ইমামের পশ্চাতে নমায আদা’ করা, ষষ্ঠ: বিতরের নমায এক রাকআত পড়া, সপ্তম: সমুদয় আহলে ছুন্নতকে ভালবাসা।

ইছলামী জামাআতের হঠকারিতা, সংকীর্ণতা এবং হাদীছ বিরোধী মনোবৃত্তির ফলে পাঞ্জাবের  অনেক  আলিম,  যাঁহারা  উহার  প্রতি সহানুভূতিশীল  এমনকি  উহার অন্তরভুক্ত ছিলেন, শুধু আহলেহাদীছ থাকার অপরাধেই উক্ত দল বর্জন করিতে বাধ্য হইয়াছেন। ‘ইছলামী জামাআতে’র নেতা এবং তাঁহার অন্ধ ভক্তের দল মুছলিম জনসাধারণ এবং তাঁহাদের নেতৃবর্গকে যেরূপ নির্মম, নিষ্ঠুর ও অভদ্রোচিতভাবে অহরহই আক্রমণ করিয়া থাকেন, তাহার ফলে বিদ্যানগণের অন্তঃকরণ উক্ত জামাআতের বিরুদ্ধে বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে। ইছলামী জামাআত অন্য কোন দলের কোন আচরণ বা সেবাকে গ্রাহ্যের মধ্যে না আনিলেও এবং এই দলের নিকট হইতে কোনরূপ শিষ্টাচারের প্রত্যাশী না থাকিলেও আমরা স্বয়ং উক্ত দলের নেতা এবং তাঁহাদের উত্তম কার্যগুলির সর্বদা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিতে কখনও কার্পণ্য করি নাই। কিন্তু ক্রমে ক্রমে এই দলটি ফির্কাবন্দীর অভিশাপে যেভাবে আক্রান্ত হইতে চলিয়াছে, নীতিনৈতিকতার সমুদয় পুরাতন বাগাড়ম্বরের মুখে ছিপি অাঁটিয়া এখন তাঁহারা প্রকাশ্যভাবে যেরূপ মামলা-মোকদ্দমায় অবতীর্ণ হইয়াছেন, সক্রিয় রাজনীতির সমুদয় কলুষকে গায়ে মাখিয়া তাঁহারা যেভাবে প্রাধান্য ও প্রতিষ্ঠা লাভের উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র গোঠ রচনা করিতে উদ্যত হইয়াছেন, তাহাতে তাঁহাদের পুরাতন ভক্ত ও অনুরক্তদের পক্ষে তাঁহাদের সম্বন্ধে শ্রদ্ধান্বিত থাকা আর সম্ভবপর হইতেছে না। সম্প্রতি এই দলটি তাঁহাদের বহু বিশ্রুত নীতিনৈতিকতার মাথা খাইয়া বিগত বন্যা প্লাবিত অঞ্চলে তাঁহাদের বিতরিত সাহায্যের বিনিময়ে অজ্ঞ জনসাধারণকে তাঁহাদের দলে ভিড়াইবার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করিয়াছেন।

আমাদের অভিমত

আমরা পরিষ্কারভাবেই ঘোষণা করিতে চাই যে, মূলনীতির দিক দিয়া এই জামাআতের ভিতর কোন অভিনবত্ব নাই। রাজনৈতিক এবং ব্যবহারিক টেকনিকের দিক দিয়া ইঁহারা যে পথের অনুসরণ করিয়া চলিয়াছেন, তাহা শুধু সংহতি বিরোধীই নয়, বরং উহা মুছলমানদিগকে এক অনিশ্চিত ও অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। অনাগত শতবর্ষকাল আন্দোলন চালাইয়াও ‘‘ইছলামী জামাআতের’’ পক্ষে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কার, রাজনীতি, ধর্মসেবা ও তাক্বওয়ার ক্ষেত্রে আহলেহাদীছগণের সমকক্ষতা লাভ করা সুদূর পরাহত। তাঁহাদের দলপরস্তী, গোঁড়ামি, অন্ধ অহমিকতা ও হাদীছ বিদ্বেষ তাঁহাদিগকে ক্রমশঃ মুসলিম জনমন্ডলী হইতে দূরেই সরাইয়া রাখিবে।

فَبَشِّرْ عِبَادِ، الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُوْلَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ وَأُوْلَئِكَ هُمْ أُوْلُوا الْأَلْبَابِ-  زمر ১৭-১৮

````




[1]. মাননীয় লেখক কর্তৃক সম্পাদিত অধুনালুপ্ত মাসিক তর্জুমাতুল হাদীছ ৬ষ্ঠ বর্ষ ১ম সংখ্যা (শ্রাবণ ১৩৬২/ডিসেম্বর ১৯৫৬) পৃঃ ৪১-৪৫ হ’তে সংকলিত। -প্রকাশক

[2]. ক্ষুদ্র-বৃহৎ ২২২ খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। -পরিচালক হা.ফা.বা।

[3]. মাওলানা কাফী (রহঃ) এখানে ‘সংঘ’ শব্দটি সমিতি বা দল অর্থে বুঝিয়েছেন, ‘বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দল’ হিসাবে নয়। ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ নামটিও আহলেহাদীছ যুবকদের সংস্থা হিসাবে বলা হয়ে থাকে মাত্র। -প্রকাশক।