ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

একটি হুঁশিয়ারী

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝিতে চরমপন্থী ‘ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ’ প্রচলনের কিঞ্চিদধিক শতবর্ষ পরে মিসর ও ভারতের মাটিতে ইসলামের নামে পাল্টা আরেক চরমপন্থী মতবাদের জন্ম হয়। এই মতবাদটি পুরা ইসলামকেই রাজনীতি গণ্য করে এবং সেই দৃষ্টিতে ইসলামের ইবাদতসমূহকে বিচার করে। এই মতবাদটির পরিষ্কার বক্তব্য হ’ল : ‘দ্বীন আসলে হুকুমতের নাম। শরী‘আত ঐ হুকুমতের কানূন মাত্র। আর ইবাদত হল ঐ কানূন ও বিধানের আনুগত্য করার নাম’। এই মতবাদ অনুযায়ী ‘ছালাত-ছিয়াম, হজ্জ-যাকাত, যিকর-তাসবীহ ইত্যাদি মানুষকে উক্ত ‘বড় ইবাদত’ তথা হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্ত্ততকারী অনুশীলনী বা ট্রেনিংকোর্স মাত্র’।[1]

বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রচারিত উক্ত চরমপন্থী দর্শনের অনুসারী দলটি যেনতেন প্রকারেণ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করাকেই ‘বড় ইবাদত’ ভাবতে শুরু করেছে এবং ইসলামের ফরয-ওয়াজিব ইবাদতসমূহকে উক্ত বড় ইবাদত হাছিলের তুলনায় ‘ছোট-খাট বিষয়’ বলে ধারণা করেছে। এই দর্শন দ্বীনকে দুনিয়া হাছিলের মাধ্যম রূপে গণ্য করেছে। ফলে এতে দ্বীন ও দুনিয়া দু’টিই হারাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা যে ব্যক্তি দুনিয়ার জন্য দুনিয়া করে, সে কেবল দুনিয়া পায়। আর যে ব্যক্তি দ্বীনের জন্য দুনিয়া করে সে ব্যক্তি দ্বীন ও দুনিয়া দু’টিই পায় (শূরা ৪২/২০)। কিন্তু যে ব্যক্তি দুনিয়ার জন্য দ্বীন করে, সে ব্যক্তি দ্বীন-দুনিয়া দু’টিই হারায় (হাজ্জ ২২/১১)

উপরোক্ত দর্শনের অনুসারীরা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বার্থে হেকমতের দোহাই দিয়ে যেকোন সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ করে থাকেন। যা অনেক সময় সেক্যুলারদের ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এদের ক্ষমতাতন্ত্রী দর্শনের অনুসারী অন্যান্য উপদলগুলি তাদের ভাষায় ‘সমাজ থেকে ময়লা ছাফ করার’ মাধ্যমে ইসলামী হুকুমত কায়েম করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং তাদের বিরোধী মতের নেতৃবৃন্দকে হত্যা ও সরকার উৎখাত করাকেই বড় ইবাদত ভেবে নিয়েছে। ফলে ইসলামের নামে তারা এখন ইসলামকেই হত্যা করছে।

অথচ মুমিন জীবনের প্রধান লক্ষ্য হ’ল তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। তাওহীদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনীতি করলে সেটা ইবাদত হবে। কেননা রাজনৈতিক শক্তি পূর্ণাঙ্গ তাওহীদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান সহায়ক শক্তি হ’তে পারে। যদিও অনেক সময় তার বিপরীত হয়ে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যে দ্বীন করলে ঐ রাজনীতি প্রতারণা হবে এবং তা গোনাহের কারণ হবে। মোটকথা দ্বীন কায়েমের অর্থ হ’ল ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা, হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা নয়। আর তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য হুকুমত কায়েম করা শর্ত নয়, বরং সহায়ক মাত্র।


[1]. দ্রঃ লেখক প্রণীত বই ‘ইক্বামতে দ্বীন, পথ ও পদ্ধতি’ পৃঃ ২৫; এবং ‘তিনটি মতবাদ’ পৃঃ ২২।