ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

উৎপত্তি

‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মতবাদটি মূলতঃ মানুষের জন্মগত কুপ্রবণতাকে উস্কে দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর থেকে আধুনিক পৃথিবীতে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের গোড়াপত্তন ঘটে। যেখানে ধর্মের চাইতে বস্ত্তকে মুখ্য হিসাবে তুলে ধরা হয়। অতঃপর বস্ত্তবাদ বিভিন্ন বেশে ও বিভিন্ন নামে লোকদের মধ্যে ঢুকে পড়তে শুরু করে। পরে ঊনবিংশ শতকে এসে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ একটি আন্দোলনে রূপ লাভ করে।

আঠারো শতকের দিকে ইংল্যান্ডের হব্স, লক এবং ফ্রান্সের ভল্টেয়ার, রুশো, মন্টেস্কু প্রমুখ চিন্তাবিদগণ ধর্মের বিরুদ্ধবাদী চেতনায় বারি সিঞ্চন করেন। তার কিছু পরে ডারউইনবাদ আল্লাহর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত The Origin of Species বা ‘প্রজাতির উৎস’ বইটিতে চার্লস ডারউইন (Charles Darwin) যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চান যে, এ বিশ্ব-প্রকৃতি ও মাখলূক্বাত সবই আপনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এর কোন বিচক্ষণ সৃষ্টিকর্তা বা পালনকর্তা নেই। পরকাল বলে কিছু নেই। প্রাণীর জন্ম, যৌবন ও লয় সবকিছুই তার স্বাভাবিক বিবর্তনের ফল। যদিও ডারউইনের এই বিবর্তনবাদ বা Theory of Evolution তার জীবদ্দশাতেই বিজ্ঞানীগণ কেউই পুরোপুরি গ্রহণ করেননি। এমনকি এই মতবাদের বড় প্রবক্তা হাক্সলে (Huxley) পর্যন্ত এর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেননি। কিন্তু স্রেফ আল্লাহদ্রোহী প্রবণতার সপক্ষে হওয়ার কারণে এ মতবাদকে গ্রহণ করা হ’ল। যা বস্ত্তবাদকে আরো প্ররোচিত করে। বরং বলা চলে যে, এই দুনিয়াসর্বস্ব দর্শন থেকেই পাশ্চাত্যের কৃষ্টি ও সভ্যতা জন্ম লাভ করে। নামকা ওয়াস্তে ধর্মে খ্রিষ্টান হ’লেও তাদের বাস্তব ক্রিয়া-কর্ম নিরেট Materialism বা বস্ত্তবাদী দর্শনের উপরে ভিত্তি করেই চলছে। একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী হ’লেও বিশ্বব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় তাঁর কোন কর্তৃত্ব আছে বলে তারা স্বীকার করে না।

বস্ত্তবাদী দার্শনিকদের মতে যেসব বস্ত্ত পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার আয়ত্তাধীন, কেবল তাই-ই সত্য। হিউম (Hume) তাঁর অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism) ও সংশয়বাদ (Scepticism)-এর সাহায্যে এই চিন্তা পদ্ধতিকে জোরালোভাবে সমর্থন করেন। এমনকি যুক্তিসিদ্ধ বিষয়টির সত্যতার জন্যেও তিনি অভিজ্ঞতাকে চূড়ান্ত মানদন্ড বলে ঘোষণা করেন। যা নাস্তিক্যবাদকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। দার্শনিক কান্ট (Kant) একটা মধ্যম পন্থা পেশ করে বলেন, আল্লাহর অস্তিত্ব, আত্মার স্থায়িত্ব ইত্যাদি অদৃশ্য বিষয়গুলি আমাদের বোধগম্য নয়। তবে আমাদের বাস্তব বিচারবোধ বা Practical wisdom এগুলোর প্রতি বিশ্বাসের দাবী জানায়। অতএব শুধু  নৈতিকতার হেফাযতের জন্য আল্লাহকে মান্য করা, তাঁকে ভয় করা ও তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করা যেতে পারে। এই মতবাদে আল্লাহকে একজন ক্ষমতাহীন ‘নিয়মতান্ত্রিক সম্রাট’ বা Constitutional Monarch-এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে মাত্র। বর্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতার বিশাল সৌধ দাঁড়িয়ে আছে মূলতঃ হিউমের (১৭১১-১৭৭৬ খৃঃ) অভিজ্ঞতাবাদ, কান্টের (১৭২৪-১৮০৪) ক্ষমতাহীন স্রষ্টাতত্ত্ব এবং ডারউইনের (১৮০৯-১৮৮২) নাস্তিক্যবাদের চোরাবালির উপরে। যেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত ও পশুত্ব সমুন্নত। যা কখনোই মানুষের কাম্য নয় এবং যার ধ্বংস অনিবার্য।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসী শিল্প বিপ্লব বস্ত্তবাদকে অধিকতর শক্তিশালী করে। ঊনবিংশ শতকে এসে বস্ত্তবাদ একটি আন্দোলনে রূপ নেয়, যা দু’টি স্বতন্ত্র ধারায় অগ্রসর হয়। ১ম ধারাটি ছিল ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্র হ’তে ধর্মকে বিতাড়িত করা। এই ধারার নেতৃত্ব ছিল দ্বিমুখী : (ক) ধর্মতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন গাফলুক, ডঃ ওয়াটসন (১৮৪৭-১৯৩৯), গেষ্টাউল্ফ, ফয়েরবাখ (১৮০৪-১৮৭২) প্রমুখ এবং (খ) রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নেতৃত্বে ছিলেন কার্লমার্কস (১৮১৮-১৮৮৩), এঙ্গেল্স (১৮২০-১৮৯৫) ও তাদের অনুসারীগণ।

২য় ধারাটি ছিল এই যে, ধর্মের বিরুদ্ধে কোনরূপ Frontal attack বা সম্মুখ হামলা না চালিয়ে কেবল ক্ষমতার আসন থেকে বিতাড়িত করলেই যথেষ্ট হবে। কেননা জীবনের বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র সমূহ থেকে জনগণ যখন ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত হবে, তখন গৃহের ক্ষুদ্র পরিসর হতে ধর্ম আস্তে আস্তে বিদায় নেবে। কিন্তু যদি তাকে সম্মুখ হামলা করা হয়, তাহলে ধর্মের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা তীব্র হয়ে উঠতে পারে। আর তা হবে এক মারাত্মক ভুল পদক্ষেপ। নাস্তিক্যবাদ ও বস্ত্তবাদের এই সুচতুর ও ধূর্ত পদ্ধতিটির নাম হ’ল ‘সেক্যুলারিজম’ বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ।