ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

মুমিনের করণীয়

প্রতিষ্ঠিত কোন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইসলামের নীতি নয়। তবে ইসলাম বিরোধী হুকুম মানতে কোন মুসলিম নাগরিক বাধ্য নয়। অতএব অমুসলিম বা ফাসেক মুসলিম সরকার উভয় শাসনামলে মুমিনের করণীয় হবে- (১) দেশে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। (২) বৈধভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। (৩) বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করা ও তার ভাল কাজের প্রশংসা করা। (৪) সরকারের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা। (৫) যালেম সরকারের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকটে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করা।

একজন মুমিন যেখানেই বসবাস করুন, সর্বদা তার জিহাদী চেতনা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি আনিল মুনকার’ (আলে ইমরান ৩/১১০) তথা ‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ’-এর মূলনীতি থেকে তিনি মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকতে পারবেন না। এজন্য তাকে নিরন্তর দাওয়াত ও সংস্কার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এককভাবে ও সংগঠিতভাবে। জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপনের জন্য শরী‘আতে কঠোর নির্দেশ এসেছে। সে হিসাবে ইসলামী সংগঠনসমূহ সরকারের যেকোন অনৈসলামী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ইছলাহের উদ্দেশ্যে চাপ প্রদানকারী সংস্থা (Pressure Organization) হিসাবে কাজ করবেন। এভাবেই সমাজে ক্রমে স্থায়ী পরিবর্তন আসবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু কোন অবস্থাতেই অনৈসলামী শাসনের সহযোগী হওয়া যাবে না।

বর্তমানে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে এবং ‘বড় ক্ষতির বদলে ছোট ক্ষতি বরণ করার’ (أَخَفُّ الضَّرَرَين) নীতির আলোকে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের সহযোগী হওয়াকে ‘জায়েয’ বলছেন। কেউ ‘ইসলামের দিকে হুকুমতকে ফিরিয়ে আনার শর্তে’ একে ‘ওয়াজিব’ বলছেন। কিন্তু আমরা নবীগণের জীবনে এর বিপরীতটাই দেখেছি। তাঁরা বাতিল সমাজে বসবাস করেও কখনো বাতিলের সঙ্গে আপোষ করেননি। তারা সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টায় বারবার নির্যাতিত হয়েছেন, হিজরত করেছেন, অনেকে নিহত হয়েছেন। আমাদের নবী (ছাঃ) বাতিল নেতাদের কাছ থেকে নেতৃত্বের টোপসহ নানাবিধ লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েছেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। কোন অবস্থায় তিনি বাতিলের সহযোগী হননি।

আমরা কি তাহ’লে ধর্মনিরপেক্ষ একটা চেয়ারের জন্য ইসলামকে কুরবানী দেব? আর এই কাজে নেতা-কর্মীদের জান-মাল উৎসর্গ করা ও হরতাল-অবরোধ, হত্যা-সন্ত্রাস, গাড়ী ভংচুর ইত্যাদি অপকর্মকে নেকীর কাজ মনে করব? এটা তো নিশ্চিত যে, ত্বাগূতকে প্রত্যাখ্যান করা ব্যতীত তাওহীদ প্রতিষ্ঠা কখনোই সম্ভব নয়। তাহ’লে কোন যুক্তিতে ত্বাগূতের সঙ্গে আপোষ হবে? আমরা কি তাহ’লে দুনিয়ার স্বার্থে আখেরাত হারাব? আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন, فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لاَ انْفِصَامَ لَهَا وَاللهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ- ‘যে ব্যক্তি ত্বাগূতকে প্রত্যাখ্যান করবে ও আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে দৃঢ়মুষ্ঠিতে ধারণ করবে এমন এক সুদৃঢ় হাতল, যা ভাঙ্গবার নয়। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৫৬)। আমরা মনে করি নবীগণের তরীকাই আমাদের জন্য মুক্তির পথ। এর বাইরের কোন পথে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে না। ইতিমধ্যে যারা উক্ত তরীকা ছেড়ে আপোষের তরীকা বেছে নিয়েছেন কিংবা সশস্ত্র বিপ্লবের পথ ধরেছেন, তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। যার নযীর আমাদের সামনেই রয়েছে।

আধুনিক চিন্তাবিদগণ যদি কোন ইসলামী দেশে ইসলামী সংবিধানের অধীনে পার্লামেন্ট ইলেকশনে প্রার্থী হওয়াকে জায়েয বা ওয়াজিব বলেন, সেটাও সঠিক হবে না। কেননা ইসলামী সংবিধানে কেবলমাত্র বিচক্ষণ নির্বাচকদের মাধ্যমেই প্রার্থী বিহীনভাবে একজন বিচক্ষণ ইসলামী গুণাবলী সম্পন্ন যোগ্য ব্যক্তি ‘আমীর’ নির্বাচিত হ’তে পারেন। অতঃপর সাধারণ জনগণ তাকে সমর্থন করবেন। ‘আমীর’ যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নিজের জন্য সীমিত সংখ্যক একটি মজলিসে শূরা মনোনয়ন দিবেন। জনগণ তাদেরকে নির্বাচন করবে না। যেভাবে দেশের বিচারপতি, যেলা প্রশাসক প্রমুখগণ সরকার কর্তৃক মনোনীত হয়ে থাকেন। জনগণ তাদের নির্বাচন করে না।

আজকাল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলিতে অনেক সময় মুসলিম নামধারী ব্যক্তিদের প্রেসিডেন্ট বা মন্ত্রী পদে দেখা যায়। এগুলি মুসলিম জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যই করা হয়। বরং এরাই ইসলামী দাওয়াতের সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে গণ্য হয়ে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায়, ইসলামী নেতারাই ইসলামের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেন। তারা অন্য ইসলামী নেতাদের নির্মূল করার চেষ্টাও করেন। তাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী জনমত শর্ত। তাছাড়াإِنَّ اللهَ لَيُؤَيِّدُ هَذَا الدِّينَ بِالرَّجُلِ الْفَاجِرِ  ‘আল্লাহ অবশ্যই (অনেক সময়) ফাসেক-ফাজের লোককে দিয়ে এই দ্বীনকে সাহায্য করে থাকেন’।[1] অতএব আমাদের দায়িত্ব হ’ল সাধ্যমত ইসলামের উপর দৃঢ় থাকা এবং সেদিকে মানুষকে দাওয়াত দেওয়া। সমাজে একে বিজয়ী করার দায়িত্ব আল্লাহর। ‘তিনিই রাজাধিরাজ। তিনি যাকে খুশী তাকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে থাকেন’ (আলে ইমরান ৩/২৬)

অতএব যদি কেউ সমাজ পরিবর্তনের মহান প্রচেষ্টায় দৃঢ় থেকে নিহত হন বা বিছানায় মৃত্যুবরণ করেন, তিনি আল্লাহর নিকটে শহীদী মর্যাদা লাভ করবেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ سَأَلَ اللهَ الشَّهَادَةَ بِصِدْقٍ بَلَّغَهُ اللهُ مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে খালেছ অন্তরে শাহাদাত কামনা করে, আল্লাহ তাকে শহীদগণের স্তরে পৌঁছে দেন, যদিও সে বিছানায় মৃত্যুবরণ করে’।[2] তিনি বলেন, مَنْ قُتِلَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ وَمَنْ مَاتَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, সে শহীদ এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করে, সে ব্যক্তি শহীদ’।[3] তিনি আরও বলেন, সত্তুর জন নিকটাত্মীয়ের জন্য তার সুফারিশ কবুল করা হবে।[4]


[1]. বুখারী ফাৎহসহ হা/৩০৬২, ৪২০২-০৩।

[2]. মুসলিম হা/১৯০৯; মিশকাত হা/৩৮০৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায়; আহমাদ হা/২২১৬৯ হাদীছ ছহীহ।

[3]. মুসলিম হা/১৯১৫; মিশকাত হা/৩৮১১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[4]. তিরমিযী হা/১৬৬৩, ইবনু মাজাহ হা/২৭৯৯, মিশকাত হা/৩৮৩৪।