ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন ও ইসলামী দর্শনের বাস্তব ফলাফল

১৯২০ সালের জানুয়ারী মাসে আমেরিকার সিনেট ‘মদ্য নিবারক আইন’ (Prohibition law) পাশ করে। কিন্তু ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে উক্ত আইন বাতিল করে। এই আইনটি কার্যকর করতে গিয়ে চৌদ্দ বছরে ২০০ লোক নিহত হয়। ৫ লাখ ৩৪ হাযার ৩৩৫ জন কারারুদ্ধ হয়। ১ কোটি ৬০ পাউন্ড জরিমানা করা হয় এবং ৪০ কোটি ৪০ লাখ পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত হয়। এতদ্ব্যতীত উক্ত আইনটি কার্যকর করতে ১৪ বছরে মার্কিন জাতিকে যে বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে হয়েছিল, তার মোটামুটি পরিমাণ ৬৫ কোটি পাউন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

Anti Saloon League নামক একটি সংস্থা কয়েক বছর ধরে পত্র-পত্রিকা, বক্তৃতা-বিবৃতি, প্রচারপত্র, ছায়াছবি, নকশা-চিত্র এবং অন্যান্য বহুবিধ উপায়ে আমেরিকানদের মন-মগজে মদের অপকারিতাকে বদ্ধমূল করে দেবার চেষ্টা করেছিল। অনুমান করা হয় যে, আন্দোলনের সূচনা থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত শুধু তাদের প্রচারকার্যেই ব্যয়িত হয়েছে সাড়ে ছয় কোটি ডলার এবং মদের অপকারিতা বিষয়ে প্রকাশিত বই-পুস্তিকার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে নয়শ’ কোটির মত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘বিশ্ব-ইতিহাসের এই বৃহত্তম সংস্কার প্রচেষ্টা’ নিষ্ফল প্রতিপন্ন হয়। কারণ এই নিষেধাজ্ঞা যতদিন কাগজপত্রে ও উপদেশের মধ্যে সীমিত ছিল, ততদিন মার্কিন জাতি তাকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু যখনই তা বাস্তবায়ন করতে যাওয়া হ’ল, তখনই তারা মদ হারানোর ভয়ে পাগলপরা হয়ে উঠলো। ফলে চেŠদ্দ বছর পূর্বে তারা যেটাকে হারাম ঘোষণা করেছিল, তারাই তাকে পুনরায় হালাল করল।

নিষিদ্ধ ঘোষণার পূর্বে আমেরিকায় মদ চোলাইয়ের অনুমোদিত দোকানের সংখ্যা ছিল ৪০০। কিন্তু নিষিদ্ধ ঘোষণার পরে মাত্র ৭ বছরের মধ্যে ৭৯,৪৩৭ জন কারখানা মালিককে গ্রেফতার এবং ৯৩,৮৩১টি মদের দোকান বাযেয়াফ্ত করা হয়। এটি ছিল সর্বমোট কারখানা ও দোকানের এক দশমাংশ। আগে যা ছিল শহর কেন্দ্রিক, এখন তা গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। অনুমান করা হয় যে, এই সময় মার্কিন জাতি বছরে অন্যূন ২০ কোটি গ্যালন মদ পানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অত্যধিক মদ্যপানের ফলে তাদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। কেবল নিউইয়র্ক শহরেই নিষিদ্ধ ঘোষণার পূর্বে যেখানে মদ্য পানে রোগাক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৭৪১ জন ও মৃতের সংখ্যা ছিল ২৫২ জন। সেখানে নিষিদ্ধ করার পরে ১৯২৬ সালে রোগাক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ হাযারে এবং মৃত্যু বরণকারীর সংখ্যা সাড়ে সাত হাযারে উপনীত হয়। এতদ্ব্যতীত দেশে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাযানি, যেনা-ব্যভিচার, সমমৈথুন, পুংমৈথুন, জুয়া, সন্ত্রাস, হত্যাকান্ড ইত্যাদি সকল প্রকার অপরাধের সংখ্যা কল্পনাতীতভাবে বেড়ে যায়। ফলে ১৯৩৩ সালে আমেরিকার Crime Council-এর ডাইরেক্টর কর্ণেল মোস (Col. Moss) বলেন, ‘বর্তমানে আমেরিকার প্রতি তিন জনে একজন পেশাদার অপরাধী। অধিকন্তু আমাদের এখানে হত্যাকান্ডের অপরাধ শতকরা সাড়ে তিনশ’ ভাগ বেড়ে গিয়েছে’।

এবারে দেখুন পৃথিবীর অন্য গোলার্ধের আরেকটি সমাজ চিত্র। চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে অন্ধকার যুগে চিরকাল মদ্যপানে অভ্যস্ত আরব জাতি ইসলাম গ্রহণ করার পরে যখন মদ্যপান নিষিদ্ধ হওয়ার ইলাহী নির্দেশ লাভ করল[1] সঙ্গে সঙ্গে তারা বিনা বাক্য ব্যয়ে মদ পরিত্যাগ করল। মুখে নেওয়া মদের পাত্র ছুঁড়ে ফেলে দিল, কেউ গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে উগরিয়ে দিল। নিজ হাতে মদের ভান্ড ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিল। মদীনার অলি-গলিতে মদের স্রোত বয়ে গেল।[2] যারা মদ ছাড়তে চায়নি, তাদের জন্য শাস্তি ঘোষণা করা হ’ল’।[3]

উপরে দু’টি সমাজচিত্র তুলে ধরা হ’ল। একটি আধুনিক সভ্যতাগর্বী আমেরিকার। অন্যটি মদীনার ইসলামী খেলাফতের। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইসলামের ঊষাকালের। যখনকার মানুষ নারী ও মদে চুর হয়ে থাকত। আরবী ভাষায় কেবল মদেরই আড়াইশ’ শব্দ ছিল। এতেই বুঝা যায়, মদ তাদের সমাজ জীবনকে কিভাবে গ্রাস করেছিল। অথচ সেই মদে অভ্যস্ত লোকগুলিকে মদ থেকে ফিরানোর জন্য কোন প্রচারণা চালানো হয়নি। Anti saloon league-এর ন্যায় কোন সমিতি গঠন করে প্রচার-প্রপাগান্ডা বাবত একটি পয়সাও ব্যয় করা হয়নি। কোনরূপ যবরদস্তি বা অস্ত্রশক্তি প্রয়োগ করতে হয়নি। মদের অপকারিতা বুঝানোর জন্য সভা-সমিতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা যুক্তিতর্কের অবতারণা করতে হয়নি। পক্ষান্তরে আধুনিক সভ্যতার কেন্দ্রস্থল বলে খ্যাত আমেরিকা এ ব্যাপারে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হ’ল। এর অন্তর্নিহিত কারণ তালাশ করলে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামের মধ্যকার নিম্নোক্ত মৌলিক দু’টি পার্থক্য ফুটে উঠবে। যেমন-

(১) ধর্মনিরপেক্ষতার মতে মানুষের পার্থিব বিধি-বিধান নির্ভর করে সম্পূর্ণরূপে তাদের খেয়াল-খুশীর উপরে। তাই ছোট-বড় সকল ব্যাপারেই তাদেরকে জনগণের সম্মতি নিতে হয়। কেননা জীবন পরিচালনার জন্য কোন স্থায়ী মানদন্ড তাদের কাছে নেই। ফলে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আজ যাকে সঠিক বলছে, কাল তাকেই বেঠিক বলছে। একারণেই চৌদ্দ বছর পূর্বে যে মার্কিন জাতি মদ নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছিল, পরে তারাই তার বিপক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করল। বলা বাহুল্য, এখানেই হ’ল গণতন্ত্রের ব্যর্থতা। যেখানে সঠিক-বেঠিক যাই-ই হৌক, অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত। এখানে হুজুগই মানদন্ড। যা একটি জংলী মতবাদ ছাড়া কিছুই নয়।

পক্ষান্তরে ইসলামের রয়েছে একটি চিরসত্য ও সুদৃঢ় মানদন্ড। যা মানুষের আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক জীবনের ছোট-বড় প্রায় সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে’।[4] এতদ্ব্যতীত যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব তাকে ইজতিহাদের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হয়।[5] সেখানে কোন মুমিনের জন্যই নিজস্ব এখতিয়ারের কোন সুযোগ নেই (আহযাব ৩৩/৩৬)। নেই কুরআন-হাদীছের উপরে ‘অধিকাংশের রায়’ বা কারু নিজস্ব বিধান চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার (আন‘আম ৬/১১৬)। ফলে যখনই তাকে মদ হারামের নির্দেশ শুনানো হয়েছে, তখনই সে তা পালন করেছে বিনা বাক্য ব্যয়ে খুশী মনে পরকালীন মুক্তির স্বার্থে।

(২) ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ জীবন পরিচালনায় ও বিধান প্রদানে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় বিশ্বাসী নয়। ফলে তাদের পুরো জীবনটাই পরিচালিত হয় প্রবৃত্তিপূজা ও স্বেচ্ছাচারিতার ভিত্তিতে। পক্ষান্তরে ইসলাম মানুষকে সর্বাগ্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের উপরে ঈমান আনার আহবান জানায়। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত এই তিনটি মূল ভিত্তির উপরে ঈমান আনার সাথে সাথে এলাহী বিধানসমূহের আনুগত্য করা মুমিনের উপরে অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাই মদ কেন তার চাইতে লোভনীয় কোন বস্ত্ত এমনকি প্রাণ বিসর্জন দিতেও সে পিছপা হয় না।


[1]. বাক্বারাহ ২/২১৯; নিসা ৪/৪৩; মায়েদাহ ৫/৯০।

[2]. বুখারী হা/৪৬২০; মুসলিম হা/১৯৮০; ইবনু কাছীর, সূরা মায়েদাহ ৯০ আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।

[3]. বুখারী হা/৬৭৭৬; মুসলিম হা/১৭০৬; মিশকাত হা/৩৬১৪-১৬ ‘দন্ডবিধিসমূহ’ অধ্যায় ‘মদ্য পানের শাস্তি’ অনুচ্ছেদ।

[4]. ইউনুস ১০/৩, ৩১; রা‘দ ১৩/২; সাজদাহ ৩২/৫।

[5]. নিসা ৪/৮২; মুহাম্মাদ ৪৭/২৪; বুখারী হা/৭৩৫২; মুসলিম হা/১৭১৬; মিশকাত হা/৩৭৩২ ‘বিচারকার্য পরিচালনা ও তাতে সাবধানতা’ অনুচ্ছেদ।