ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

بسم الله الرحمن الرحيم

نحمده ونصلى على رسوله الكريم أما بعد:

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ :

‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ঐ মতাদর্শকে বলা হয়, যা কোন ধর্মের অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ যে মতাদর্শের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’-কে ইংরেজীতে ‘সেক্যুলারিজম’ (Secularism) ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘সেক্যুলারাইট’ (Secularite) বলা হয়। কিন্তু আরবীতে ‘ইলমা-নিয়াহ’ (العِلْمانية ) বলা হয় নিয়ম বিরুদ্ধভাবে। কেননা এই শব্দটির সাথে ‘ইল্ম’ (العلم )-এর কোন সম্পর্ক নেই। আরবী ‘ইল্ম’ শব্দটি ইংরেজী ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় Science বা ‘বিজ্ঞান’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এরপরে তার সাথে ان যোগ করা হয়েছে মূল অর্থকে জোরদার করার জন্য। যেমন রূহানীয়াহ, রববানীয়াহ, জিসমানীয়াহ, নূরানীয়াহ ইত্যাদি। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে Secularism-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Any movement in society directed away from otherworldliness to life on earth... ‘এটি এমন একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম, যা মানুষকে আখেরাতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র পার্থিব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করায়’।[1] অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে বলা হয়েছে, The belief that religion should not be involved in the organization of society, education etc. ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ এমন একটি বিশ্বাস যে, ধর্মকে কোনরূপ সামাজিক ও শিক্ষাগত প্রভৃতি বিষয়ে যুক্ত হওয়া উচিত নয়’।[2]

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের রূহ হ’ল ‘দুনিয়া’। এখানে ধর্মীয় কোন কিছুর প্রবেশাধিকার নেই। ইসলামী দুনিয়ায় প্রথম যার রাষ্ট্রীয় প্রতিফলন ঘটে তুরষ্কে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘ইসলামী খেলাফত’ উৎখাত করে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ ‘প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আধুনিক কালে রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড থেকে ধর্মকে পৃথক করাই (فَصْلُ الدِّيْنِ عَنِ الدَّوْلَةِ) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। অবশ্য যদি এর দ্বারা জীবন থেকে ধর্মকে পৃথক করা বুঝানো হয়, তবে সেটাই যথার্থ হবে।

তাই বলা চলে যে, ধর্মহীনতার উপরে জীবনকে প্রতিষ্ঠা করাই হ’ল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল কথা (هِىَ إِقَامَةُ الْحَيَاةِ عَلَى غَيْرِ الدِّيْنِ)। উদার গণতান্ত্রিক সমাজে ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনে সহ্য করা হয়। সেজন্য সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদটি ধর্মহীন বা Non-Religious। পক্ষান্তরে নাস্তিক ও কম্যুনিষ্ট দেশসমূহে এই মতবাদটি ধর্মবিরোধী বা Anti-Religious। ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনের উভয়ক্ষেত্রে এই মতবাদটি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা মুসলিম জীবনের ভিত্তিই হ’ল ইসলাম ধর্মের উপরে। ‘ইসলাম’ পরিপূর্ণ একটি ‘দ্বীন’ (মায়েদাহ ৫/৩)। মুমিন জীবনের কোন একটি দিক ও বিভাগ ইসলামের আওতামুক্ত নয়।

কুরআন নাযিলের পরে বিগত সকল এলাহী দ্বীনের হুকুম রহিত হয়ে গেছে। বিশ্বমানবতার জন্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ দ্বীন হ’ল ‘ইসলাম’। এ দ্বীন আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ‘অহি’-র উপরে ভিত্তিশীল। যেখানে কোনরূপ বাতিলের প্রবেশাধিকার নেই (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪২)। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) যে দ্বীন রেখে গিয়েছেন, তা স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন। যদি বনু ইস্রাঈলের নবী মূসা (আঃ) আজ জীবিত থাকতেন, তাহ’লে এই দ্বীনের অনুসরণ ব্যতীত তাঁর কোন উপায় থাকত না’।[3] এ যুগে যদি কেউ দ্বীনে মুহাম্মাদী পরিত্যাগ করে, তবে সে অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে’।[4] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর কসম করে বলছি, ইহূদী হৌক বা নাছারা হৌক, যে ব্যক্তি আমার আগমনবার্তা শুনেছে, অথচ আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি (অর্থাৎ ইসলাম), তার উপরে ঈমান আনেনি, সে ব্যক্তি অবশ্যই জাহান্নামী হবে’।[5] অথচ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হ’ল, মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত একটি বস্ত্তবাদী দর্শনের নাম, যেখানে অহি-র বিধানের কোন প্রবেশাধিকার নেই। যার একমাত্র লক্ষ্য হ’ল যেনতেন প্রকারেণ ‘দুনিয়া’ হাছিল করা।

বর্তমান যুগে গণতন্ত্রের আড়ালে ধর্মনিরপেক্ষতাকে লালন করা হচ্ছে এবং বৈষয়িক জীবন থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। ‘ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা’। ‘ধর্মে কোন রাজনীতি নেই। রাজনীতিতে কোন ধর্ম নেই’। এই বক্তব্যগুলিতে অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। অন্যান্য ধর্ম মানুষের মনগড়া। পক্ষান্তরে ইসলাম হ’ল আল্লাহ প্রেরিত পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। যার মধ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি সহ মানব কল্যাণে সবকিছুই রয়েছে। যেখানে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের স্ব স্ব ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। মূলতঃ এসব বক্তব্যের উদ্দেশ্য হ’ল আদম সন্তানকে ইসলামের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা এবং মানুষকে আল্লাহর গোলামী থেকে ফিরিয়ে নিজেদের গোলামীতে আবদ্ধ করা।



[1]. The New Encyclopaedia Britanica. 15th Edn. 2002. Vol-X. P. 594. সেখানে আরো বলা হয়েছে, The movement towad secularism has been in progress during the entire course of modern history and has often been viewed as being anti-Christian and anti religious.

[2]. A.S. Hornby, Oxford Advanced Learner's Dictionary (Oxford University Press, 2002), P. 1155.

[3]. আহমাদ হা/১৫১৯৫; বায়হাক্বী; আলবানী, মিশকাত হা/১৭৭, সনদ হাসান।

[4]. দারেমী হা/৪৩৫, সনদ হাসান; মিশকাত হা/১৯৪।

[5]. মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০।