দাওয়াত ও জিহাদ

তিনটি যুগ

উপমাহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনকে আমরা তিনটি প্রধান যুগে বিভক্ত করতে পারি: প্রাথমিক যুগ (২৩-৩৭৫হিঃ), অবক্ষয় যুগ (৩৭৫-১১১৪হিঃ) ও আধুনিক যুগ (১১১৪হিঃ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত)।
১. প্রাথমিক বা স্বর্ণযুগ : যা ২৩ হিজরী থেকে ৩৭৫ হিজরী (৬৪৩-৯৮৫খৃঃ) পর্যন্ত ব্যাপ্ত। এই যুগে উমাইয়া খেলাফতের শেষ (১৩২হিঃ/৭৫০খৃঃ) পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ১৮ বা ২৫ জন ছাহাবীসহ ২৪৫ জন তাবেঈ ও তাবে তাবেঈ হিন্দুস্থানে আগমন করেন। সর্বশেষ ছাহাবী সিনান বিন সালামাহ আল-হুযালী ৪৮ হ’তে ৫৩ হিজরী পর্যন্ত দামেষ্কের উমাইয়া খলীফার পক্ষ হ’তে সিন্ধুর গভর্ণর ছিলেন। তিনি বেলুচিস্তানে শাহাদাত বরণ করেন। হাফেয ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪হিঃ) বলেন,
وَكَانَ فِىْ عَسَاكِرِ بَنِىْ أُمَيَّةَ وَجُيُوْشِهِمْ فِى الْغَزْوِ الصَّالِحُوْنَ وَالأَوْلِيَاءُ وَالْعُلَمَاءُ مِنْ كِبَارِ التَّابِعِيْنَ، فِىْ كُلِّ جَيْشٍ مِّنْهُمْ شَرْذِمَةٌ عَظِيْمَةٌ يَنْصُرُ اللهُ بِهِمْ دِيْنَهُ -
‘উমাইয়া যুগে প্রত্যেক জিহাদী কাফেলার সাথে নেককার ও সাধু ব্যক্তিগণ এবং উঁচুদরের তাবেঈ বিদ্বানগণের একটি বিরাট দল থাকতেন, যাঁদের মাধ্যমে আল্লাহ পাক তাঁর দ্বীনকে সাহায্য করেছেন’। তাঁদের দাওয়াত ও তাবলীগে সিন্ধু এলাকায় মুসলিম জনসংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, ৯৩ হিজরী মোতাবেক ৭১২ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মাদ বিন ক্বাসিম যখন সিন্ধু জয়ে আসেন, তখন কেবলমাত্র মুলতানের মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য তাঁকে সেখানে ৫০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য মোতায়েন করতে হয়। জেরুযালেমের বিখ্যাত মুসলিম ভূ-পর্যটক শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বেশারী আল-মাক্বদেসী পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম এলাকা ভ্রমণ শেষে ৩৭৫ হিজরী মোতাবেক ৯৮৫ খৃষ্টাব্দে যখন ভারতবর্ষের তৎকালীন ইসলামী রাজধানী বর্তমান করাচীর সন্নিকটবর্তী সিন্ধুর মানছূরাতে এলেন, তখন সেখানকার মুসলমানদের ‘মাযহাব’ বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি স্বীয় ভ্রমণগ্রন্থে বলেন,
أَكْثَرُهُمْ أَصْحَابُ حَدِيْثٍ- ‘আকছারুহুম আছহা-বু হাদীছিন’ অর্থাৎ ‘তাদের অধিকাংশ অধিবাসী হ’লেন আহলেহাদীছ’। বলা আবশ্যক যে, মাক্বদেসী নিজে ছিলেন ‘হানাফী’। শুধু সিন্ধু বা ভারতবর্ষ নয়, ঐ সময় পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম এলাকাতেও আহলেহাদীছ জনসংখ্যার আধিক্য ছিল। যেমন ইরাকের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক আবু মানছূর আব্দুল ক্বাহির বাগদাদী (মৃঃ ৪২৯ হিঃ) মাক্বদেসীর প্রায় ৫০ বৎসর পরে তৎকালীন ইসলামী দুনিয়ায় আহলেহাদীছগণের অবস্থান সম্পর্কে বলেন,
ثُغُوْرُ الرُّوْمِ وَالْجَزِيْرَةِ وَثُغُوْرُ الشَّامِ وَثُغُوْرُ آذَرْبَيْجَانَ وَبَابُ الْأَبْوَابِ كُلُّهُمْ عَلَي مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَكَذَالِكَ ثُغُوْرُ أَفْرِيْقِيَّةَ وَأَنْدَلُسَ وَكُلُّ ثِغَرِ وَرَاءِ بَحْرِ الْمَغْرِبِ أَهْلُهُ مِنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ وَكَذَالِكَ ثُغُوْرُ الْيَمَنِ عَلَي سَاحِلِ الزَّنْجِ وَأَمَّا ثُغُوْرُ أَهْلِ مَا وَرَاءِ النَّهْرِ فِيْ وُجُوْهِ التُّرْكِ وَالصِّيْنِ فَهُمْ فَرِيْقَانِ: إِمَّا شَافِعِيَّةٌ وَإِمَّا مِنْ أَصْحَابِ أَبِيْ حَنِيْفَةَ-
‘রূম সীমান্ত, আলজেরিয়া, সিরিয়া, আযারবাইজান, বাবুল আবওয়াব বা মধ্য তুর্কিস্থান প্রভৃতি এলাকার সকল মুসলিম ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। অমনিভাবে আফ্রিকা, স্পেন ও পশ্চিম সাগরের পশ্চাদবর্তী দেশ সমূহের সমুদয় মুসলিম ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। একইভাবে ইথিওপিয়ার উপকূলবর্তী ইয়ামন সীমান্তের সকল অধিবাসী ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। অবশ্য তুর্কিস্থান ও চীন অভিমুখী নহরপার এলাকার মুসলমানেরা দু’দলে বিভক্ত ছিল। একদল শাফেঈ ও একদল হানাফী’। লক্ষণীয় যে, মাক্বদেসীর ন্যায় আব্দুল ক্বাহির বাগদাদীও এখানে হানাফী ও শাফেঈদের থেকে পৃথকভাবে ‘আহলেহাদীছ’-এর বর্ণনা দিয়েছেন।
২. অবক্ষয় যুগ : ৩৭৫ হিজরী হ’তে ১১১৪ হিজরী (৯৮৫-১৭০৩খৃঃ) পর্যন্ত প্রায় সোয়া ৭ শত বৎসর পর্যন্ত ব্যপ্ত। এই যুগে ইলমে হাদীছ ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের উপরে নেমে আসে অত্যাচার, নির্যাতন ও রাজনৈতিক অনুদারতার এক দীর্ঘ বিভীষিকাপূর্ণ গাঢ় অমানিশা। ৩৭৫ হিজরীর পর পরই সিন্ধুর মানছূরার শাসন ক্ষমতা আহলেহাদীছদের নিকট হ’তে কট্টর হিংসুক ইসমাঈলী শী‘আরা ছিনিয়ে নেয়। তারা মুলতানের জামে মসজিদ বন্ধ করে দেয়। সমস্ত সুন্নী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়। মুহাদ্দিছগণকে সিন্ধু থেকে বের করে দেয়। ইলমে হাদীছ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে মক্কা, মদীনা প্রভৃতি স্থানে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যদিও পরবর্তীতে মুহাম্মাদ ঘোরী এই এলাকা জয় করেন ও তাঁর প্রতিনিধি নাছীরুদ্দীন কোবাচা এই এলাকা শাসন করেন। কিন্তু অষ্টম শতাব্দী হিজরীর মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত এখানে ইসমাঈলী সামারু শী‘আদের আধিপত্য বজায় ছিল।

অন্যদিকে ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দে আফগান নেতা মু‘ইয্যুদ্দীন ওরফে শিহাবুদ্দীন মুহাম্মাদ ঘোরীর মাধ্যমে দিল্লীতে ও বখতিয়ার খিলজীর মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘আহলুর রায়’ হানাফী শাসন কায়েম হয়। যাদের হাদীছ বিদ্বেষ ও মাযহাব প্রীতির কথা আমরা ইতিপূর্বে দেখে এসেছি। তখন থেকেই সিন্ধু হ’তে বাংলা পর্যন্ত কখনও তুর্কী কখনও গযনবী, কখনও আফগান ও কখনো মোগলদের দ্বারা উপমহাদেশ শাসিত হয় এবং মূল আরবীয় ইসলামী শাসন থেকে উপমহাদেশ চিরবঞ্চিত হয়। ফলে একদিকে রাজনৈতিক অনুদারতা, অন্যদিকে তাক্বলীদপন্থী আলেমদের সংকীর্ণতা, জনসাধারণের অজ্ঞতা ও আহলেহাদীছ আলেমদের স্বল্পতার কারণে আহলেহাদীছ আন্দোলন ভারতবর্ষে স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবু এই সর্বব্যাপী অন্ধকারের মধ্যেও আল্লাহ পাক তাঁর অবিমিশ্র দ্বীনকে কিছু সংখ্যক হাদীছপন্থী আলেম ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঁচিয়ে রাখেন।

৬. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৯/৯৩ পৃঃ ‘সমরকন্দ বিজয়’ অনুচ্ছেদ।

৭. আহসানুত তাক্বাসীম ৪৮১ পৃঃ।

৮. কিতাবু উছূলিদ্দীন ১/৩১৭ পৃঃ।