দাওয়াত ও জিহাদ

হাদীছের কিতাবসমূহের আগমন

১. হাদীছের কিতাব সমূহের মধ্যে ভারতে সর্বপ্রথম যে কিতাবের আগমন ঘটে, তার নাম ‘মাশারেকুল আন্ওয়ার’। ইমাম রাযিউদ্দীন হাসান বিন মুহাম্মাদ ছাগানী লাহোরী (৫৭৭-৬৫০ হিঃ/১১৮১-১২৫২ খৃঃ) কর্তৃক ছহীহ বুখারী ও মুসলিম হ’তে চয়নকৃত ২২৫৩ টি ক্বওলী হাদীছের এই গুরুত্বপূর্ণ সংকলনটি সপ্তম শতাব্দী হিজরীর মধ্যবর্তী সময়ে দিল্লীতে আসে। নিযামুদ্দীন আউলিয়া (৬৩৪-৭২৫হিঃ/১২৩৬-১৩২৫খৃঃ) এই সংকলনটি মুখস্থ করেন। অষ্টম শতাব্দী হিজরীতে মুহাম্মাদ তুগলকের সময়ে (৭২৫-৭৫২হিঃ/১২৩৫-১৩৫২খৃঃ) দিল্লীতে এই সংকলনটির মাত্র একটি কপি মওজুদ ছিল।

২. ছহীহ বুখারী ও মুসলিম : সপ্তম শতাব্দী হিজরীর শেষ দিকে সর্বপ্রথম আল্লামা শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা বুখারী (মৃঃ ৭০০/১৩০০খৃঃ) কর্তৃক বাংলাদেশের তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁয়ে আনা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে বুখারী ও মুসলিমের দরস দেন এবং দীর্ঘ ২২ বছর যাবত সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্বা-লাল্লাহু ও ক্বা-লার রাসূলের অমিয় সুধা পান করিয়ে বাংলা, বিহার ও আশপাশের অগণিত জ্ঞানপিপাসু মানুষকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন গড়ায় উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে বার ভূঁইয়াদের রাজত্বকাল(৯০০-৯৪৫/১৪৯২-১৫৩৮খৃঃ) পর্যন্ত প্রায় আড়াইশত বৎসর সোনারগাঁও ইলমে হাদীছের মারকায বা কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল। এই সময় বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ (৯০০-৯২৪/১৪৯৩-১৫১৮খৃঃ) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করার সাথে সাথে ইলমে কুরআন ও ইলমে হাদীছের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি ৯০৭ হিজরীর ১লা রামাযান মোতাবেক ১৫০২ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে মালদহ যেলার গৌড় ও পান্ডুয়াতে বড় ধরনের দু’টি মাদরাসা কায়েম করেন এবং সিলেবাসে ইলমে হাদীছকে অবশ্যপাঠ্য করে দেন। রাজধানী একডালার (বর্তমানে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর অঞ্চলে) জন্য বুখারী তিন খন্ডে সংকলন করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে মুহাদ্দিছগণকে তিনি রাজধানী একডালাতে সমবেত করেন। ইলমে হাদীছের প্রতি এই পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তাঁকে সমসাময়িক দক্ষিণ ভারতের গুজরাট রাজ্যের মুযাফফরশাহী সালত্বানাতের (৮৬৩-৯৮০হিঃ/১৪৫৮-১৫৭২খৃঃ) সঙ্গে তুলনা করা হয়।

যাই হোক মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা ও তাঁর পরবর্তী হাদীছ পিপাসু ছাত্র ও শাসকদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের মানুষ পুনরায় তাদের হারানো ঐতিহ্য তথা হাদীছ অনুযায়ী আমলের জাযবা ফিরে পায়। এজন্যই যথার্থভাবে বলা চলে যে, উত্তর ও পূর্বভারতীয় উপমহাদেশে ছহীহায়নের প্রথম শিক্ষাদাতা হিসাবে বাংলাদেশ সত্যিই একটি গৌরবধন্য দেশ। ফালিল্লা-হিল হাম্দ

৩. মাছাবীহ : ইমাম মুহিউস সুন্নাহ আবু মুহাম্মাদ হুসায়েন বিন মাস‘ঊদ আল-বাগাভী (মৃঃ ৫১৬হিঃ) সংকলিত ‘মাছাবীহুস সুন্নাহ’ ৮ম শতাব্দী হিজরীর মধ্যভাগে হিন্দুস্থানে আসে।

৪. মিশকাত : অমনিভাবে ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-খত্বীব তাবরেযী (মৃঃ ৭৩৯হিঃ) সম্পাদিত ‘মিশকাতুল মাছাবীহ’ ৯ম শতাব্দী হিজরীর প্রথম দিকে জৌনপুর কুতুবখানায় আসে।

৫. সুনানে আরবা‘আহ : নাসাঈ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ এবং সুনানে বায়হাক্বী, মুস্তাদরাকে হাকেম প্রভৃতি হাদীছ গ্রন্থ ৯ম শতাব্দী হিজরীতে বিহারের খ্যাতনামা মনীষী সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ও শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামার জামাতা আল্লামা শারফুদ্দীন আহমাদ বিন ইয়াহ্ইয়া মুনীরী (৬৬১-৭৮২হিঃ/১২৬০-১৩৮১খৃঃ) হেজায থেকে আনিয়ে নেন।

উপরোক্ত আলোচনায় বুঝা গেল যে, ৭ম শতাব্দী হ’তে ৯ম শতাব্দী হিজরী সময়কালের মধ্যেই উত্তর ও পূর্বভারতে সর্বপ্রথম প্রচলিত হাদীছ গ্রন্থ সমূহের আগমন ঘটে। কিন্তু ছাপার ব্যবস্থা না থাকায়, সরকারী চাকুরীতে এসবের কোন প্রয়োজন না হওয়ায়, শিক্ষার সিলেবাসে তাফসীর ও হাদীছ না থাকায় এবং আহলেহাদীছ আলেমদের সংখ্যাল্পতা ও সর্বোপরি রাজনৈতিক অনুদারতার কারণে এতদঞ্চলের মুসলমানগণ কুরআন ও হাদীছের মূল ইসলাম হ’তে অনেক দূরে চলে যায়। এসব গ্রন্থাবলীর দু’একটি হস্তলিখিত কপি বিশেষ বিশেষ আহলেহাদীছ আলেমদের নিকটেই মাত্র পাওয়া যেত, যা ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে। ফলে ‘পপুলার’ (Popular) ও রেওয়াজী ইসলামকেই মানুষ প্রকৃত ইসলাম ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এর বিরোধী কিছু দেখলেই তার বিরুদ্ধে খÿহস্ত হয়ে উঠতে থাকে। যেমন বিখ্যাত সাধক ও মাশারেকুল আনওয়ার হাদীছ গ্রন্থের হাফেয শায়খ নিযামুদ্দীন আউলিয়া (৬৩৪-৭২৫হিঃ/১২৩৬-১৩২৫খৃঃ) যখন সুলতান গিয়াছুদ্দীন তুগলকের সময়ে (১৩২০-১৩২৫খৃঃ) দিল্লীর সেরা আলেমদের সঙ্গে একটি মাসআলায় হাদীছ দ্বারা জওয়াব দিতে থাকেন, তখন তারা পরিষ্কার বলে দেন যে,

هند مين فقهى روايات كى قانونى حيثيت خود احاديث سے بهى زياده هـے، آپ ابو حنيفه كى رائـے پيش كيجئـے ـ

‘ভারতীয় ইসলামী আইনশাস্ত্রে হাদীছের চাইতে ফিক্বহের গুরুত্ব অধিক। অতএব আপনি হাদীছ বাদ দিয়ে আবু হানীফার রায় পেশ করুন’। তৎকালীন ভারতবর্ষের সেরা ফক্বীহদের এই আচরণ দেখে শায়খ নিযামুদ্দীন আউলিয়া এই বলে দুঃখ করে দরবার থেকে বেরিয়ে এলেন যে,

ــــے ملكــــ مسلمان كب تك باقى رهينگے جهاںــــــــــــــــے كو احاديث پر ـــــــــــــــے ؟

‘ঐ দেশের মুসলমান কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে, যে দেশে একজন ব্যক্তির রায়কে হাদীছের উপরে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে?’ আলাউদ্দীন খিলজীর সময়ে (৬৯৫-৭১৫হিঃ/১২৯৬-১৩১৬খৃঃ) খ্যাতনামা মিসরী মুহাদ্দিছ শামসুদ্দীন তুর্ক হাদীছের কিতাব সমূহ নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। কিন্তু মুলতানে এসে জানতে পারেন যে, আলাউদ্দীন খিলজী ছালাতে অভ্যস্ত নন এবং তাঁর শাসনাধীনে ভারতীয় ইসলামী শিক্ষার সিলেবাসে ইলমে হাদীছকে বাদ দিয়ে স্রেফ হানাফী ফিক্বহ চালু রাখা হয়েছে। তিনি দুঃখ করে আলাউদ্দীন খিলজীকে একটি চিঠি পাঠিয়ে মুলতান থেকে মিসরে ফিরে গেলেন। ঐ সময়ে ভারতের ৪৬ জন  সেরা আলেমের মধ্যে শামসুদ্দীন ইয়াহ্ইয়া (মৃঃ ৭৪৭হিঃ/১৩৪৬খৃঃ) নামক মাত্র একজন আলেমের মধ্যে ইলমে হাদীছের প্রতি কিছুটা আগ্রহ ছিল। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬হিঃ/১৭০৩-১৭৬২খৃঃ) যখন কুরআনের প্রথম ফারসী তরজমা ‘ফাৎহুর রহমান’ লেখেন, তখন দিল্লীর আলেমরা কুরআন বিকৃতির ধুয়া তুলে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। শায়খ নিযামুদ্দীন আউলিয়া ও শাহ অলিউল্লাহর বিরুদ্ধে রায় ও মাযহাবপন্থী আলেমদের যে দুঃসাহস আমরা দেখেছি, তা কেবল সে যুগের জন্যই সীমাবদ্ধ নয়, আজও যাঁরা বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে ইসলামী আইন ও শাসন ব্যবস্থা কায়েমের প্রচেষ্টায় রত আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ইসলামের নামে এই দুষ্ট প্রকৃতির আলেমরা ও তাদের অন্ধভক্তরা সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আছে।