দাওয়াত ও জিহাদ

বিপর্যয়ের কারণ

৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০৬ খৃষ্টাব্দে আফগান বিজেতা শিহাবুদ্দীন মুহাম্মাদ ঘোরী (১১৮৬-১২০৬ খৃঃ) কর্তৃক দিল্লী জয় ও একই সময়ে তাঁর  তুর্কী গোলাম ও সেনাপতি ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বাংলা জয়ের ফলে উত্তর ও পূর্ব ভারতের বিশাল এলাকায় মুসলমানদের সামরিক ও রাজনৈতিক বিজয়াভিযান শুরু হয়। বখতিয়ার খিলজীসহ উপমহাদেশে যে সকল বিজেতা সামরিক নেতার আগমন ঘটে, তাঁদের মধ্যে আলপ্তগীন, সবুক্তগীন, কুতুবুদ্দীন আইবেক, ইলতুত্মিশ প্রমুখ সকলেই ছিলেন নও মুসলিম অনারব তুর্কী গোলাম ও মাযহাবের দিক দিয়ে ‘হানাফী’। পরবর্তীতে নও মুসলিম মোগল শাসকরাও ছিলেন তুর্কীদেরই একটি শাখা। এঁরা বিজেতা হ’লেও ইসলামের প্রকৃত নমুনা ছিলেন না। তাঁদের শাসন ব্যবস্থাও ইসলামী ছিল না। তাঁদের সঙ্গে আসা ভাগ্যান্বেষী পীর-ফকীরদের ত্যাগী চরিত্র ও অভিনব প্রচার কৌশলে এদেশের বহুলোক মুসলমান হয়ে যায়। কিন্তু এসব বিজেতাদের এবং তাঁদের অনুসরণীয় ছূফী ও দরবেশদের মাধ্যমে যে ইসলাম এ দেশে প্রচারিত হয়, তা ছিল মূল আরবীয় ইসলাম হ’তে অনেক দূরে। এখানে রায় ও ক্বিয়াসের বাড়াবাড়ি ছিল, ছিল পীরপূজা, কবরপূজা সহ নানাবিধ শিরক ও বিদ‘আতের ছড়াছড়ি। আলেমদের প্রচারিত বিদ‘আতে হাসানাহর সুযোগে এখানে অনুপ্রবেশ ঘটে প্রতিবেশী হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির বহু কিছু অনুষ্ঠান ইসলামের লেবাস পরিধান করে। ফলে বখতিয়ার খিলজীর সামরিক বিজয়ের প্রায় পৌনে ৬০০ বছর পূর্ব থেকে বাংলাদেশের মুসলমান যে মূল ও অবিমিশ্র আরবীয় ইসলামে অভ্যস্ত ছিল, তা থেকে তারা ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে এবং ছূফীদের ও শাসকদের চালু করা বিকৃত ইসলামকে যথার্থ ইসলাম ভাবতে শুরু করে। যদিও ব্যতিক্রম সে যুগেও ছিল, এ যুগেও আছে।

দক্ষিণ ভারতীয় উপকূল ও ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে ইসলামের বিকৃতি কম ছিল। পক্ষান্তরে দিল্লী হ’তে বাংলা পর্যন্ত বিশাল উত্তর ও পূর্বভারতীয় এলাকায় প্রধানতঃ তুর্কী, আফগান ও মোগল শাসনের পৃষ্ঠপোষকতা ও তাদের আমলে মাযহাবী আলেমদের দুঃখজনক অনুদারতা, ইসলামী শিক্ষা সিলেবাসে কুরআনের তাফসীর ও ইলমে হাদীছের বদলে মাযহাবী ফিক্বহ, মানতেক-ফালসাফা, ইলমে কালাম তথা তর্কশাস্ত্র ও মা‘কূলাতের কেতাবসমূহ সিলেবাসভুক্ত করণ, সরকারী চাকুরীতে হানাফী ফিক্বহে দক্ষতা অর্জনের শর্তারোপ ও আহলেহাদীছ আলেমদের সংখ্যাল্পতার কারণে কুরআন ও হাদীছের নির্ভেজাল ইসলাম শাব্দিক অর্থেই সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে থেকে যায় বলা চলে। দ্বাদশ শতাব্দী হিজরীতে শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হিঃ/১৭০৩-১৭৬২ খৃঃ)-এর সময়কাল পর্যন্ত কুরআনের তরজমা ‘গুনাহে কবীরা’ বলে গণ্য করা হ’ত। আজ থেকে পৌনে দু’শ বছর আগে শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (১১৫৯-১২৩৯ হিঃ/১৭৪৭-১৮২৪ খৃঃ)-এর মাদরাসায় সেই সময়ে মাত্র দু’খানা বুখারী শরীফ ছিল। যার ছিন্নপত্র সমূহ পাঠদানের সময় ছাত্রদের নিকটে সরবরাহ করা করা হ’ত। অতঃপর পাঠদান শেষে জমা নেওয়া হ’ত। দিল্লীর যে মাদরাসা রহীমিয়াহ ছিল তৎকালীন ভারতের শ্রেষ্ঠ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র, তার অবস্থা যদি এই হয়, তাহ’লে ভারতের অন্যান্য এলাকার অবস্থা কেমন ছিল তা সহজেই অনুমেয়। ভারতের মুসলমানেরা কি কারণে হাদীছের ইলম থেকে দূরে ছিল, নিম্নের সময়চিত্র দ্বারা কিছুটা অনুধাবন করা যাবে।