আক্বীদায়ে মোহাম্মাদী বা মাযহাবে আহলেহাদীছ

উপক্রমণিকা

কথিত আছে, ‘কাজীর গরু তাঁর পুঁথিতে, গোয়ালে নহে’। আমাদের অবস্থাও যেন সেইরূপ মনে হয়। আমাদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন ও হাদীছ দেখিলে মনে হয় বিশ্বের মুসলমান সমষ্টিগত ভাবে মাত্র একটি দল। বলিতে কি, খায়রুল কুরূনের সেই সনাতন যুগে ছিল ঠিক তাই। তৎপর আমাদের শ্রদ্ধেয় মনীষীগণের মধ্যে আক্বীদায় বা ধর্ম বিশ্বাসে মতভেদ হইতে থাকায় প্রথমতঃ আমরা দেখিতে পাই, মুসলমানগণ মোটামুটি দশ ভাগে বিভক্ত হইয়া পড়ে। যথা: আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত, খারেজী, শী‘আহ, মো‘তাযেলা, মুরজিয়াহ, মোশাবেবহা, জাহমিয়া, যেরারীয়াহ, নাজ্জারীয়াহ, কেলাবীয়াহ। প্রথম দল ব্যতীত অবশিষ্ট দলগুলি প্রায় প্রত্যেকেই বহুবিধ দলে বিভক্ত হয়। খারেজী পনর ভাগে, শী‘আহ তিন ভাগে, রাফেযী চৌদ্দ ভাগে,[1] মুরজিয়াহ বারো ভাগে, মোশাবেবহা তিন ভাগে ইত্যাদি। উপরোক্ত বর্ণনায় মনে হয় মুসলমানগণ যেন চিরদিনই বিভাগপ্রিয়! সেই জন্যই তো আল্লাহ স্বীয় পবিত্র কুরআনে বজ্রনিনাদে ‘ওয়ালা তাফাররাকু’- ‘তোমরা দলে দলে বিভক্ত হইওনা’ বাক্যের দ্বারা আমাদের এই আচরণের ঘোর প্রতিবাদ করিয়াছেন। এখন বর্ণিত প্রথম দল আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আতের কথা। ইহারাই নাজী ফেরকা নামে পরিচিত। আমাদের প্রিয় নবী (ছাঃ) ইহাদিগের পথকেই ‘মা আনা আলাইহে ওয়া আছহাবী’ এই আখ্যায় আখ্যায়িত করিয়াছেন। ইহাদের মাত্র একটি দল। ইহাদিগকেই ইসলামের স্বর্ণযুগে ‘আছহাবুল হাদীছ’ বা ‘আহলেহাদীছ’ বলিয়া সম্মানিত করা হইয়াছে। অবশিষ্ট নয়টি দল প্রিয় হযরতের (ছাঃ) উক্তি মতে ৭২ ফেরকার অন্তর্গত। এহেন সত্য সনাতন আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত দল কালের কুটিল চক্রে অক্ষত দেহে থাকিতে পারিল না। কালে কালে তাহাতেও ভাঙ্গন ধরিল। উক্ত সুন্নী দলের মহামান্য  ইমাম ও ফকীহগণের আক্বীদা ও ধর্মবিশ্বাস প্রায় অভিন্ন হইলেও শাখায়-প্রশাখায় আসিয়া সামান্য সামান্য বিষয় লইয়া তাহাদের মধ্যে মতভেদ হইতে থাকায় ও তাহাদের সেই সুচিন্তিত অভিমতগুলি লিখিতভাবে প্রকাশ পাওয়ায়, জনসাধারণ যে যাঁহার নিকটের ও যাঁহার ভক্ত, তাঁহার প্রাধান্য ও মর্যাদা রক্ষার্থে তাঁহার দিকে সভক্তি নিজকে সম্বন্ধ করতঃ সমাজে নূতন ভাবে নিজ পরিচয় প্রদান করিল। যেমন শ্রদ্ধেয় বড় ইমাম হযরত আবু হানীফা (রঃ)-এর  একজন  প্রিয়  শিষ্য ও একান্ত অনুরক্ত স্বীয় মোর্শেদ বা ওস্তাদের সুচিন্তিত অভিমতগুলি অতি ভক্তি বশতঃ অভ্রান্ত মনে করিয়া সাদরে গ্রহণ পূর্বক সমাজে সগর্বে প্রকাশ করিলেন যে, আমি ‘হানাফী’। অতঃপর নিজ দলের পুষ্টি সাধনে তিনি তৎপর হইলেন। আর একজন ঐরূপে একজন বিশিষ্ট ইমামের ভক্ত ও অনুরক্ত হইয়া নিজেকে ‘শাফেঈ’ নামে আখ্যায়িত করতঃ তাহার প্রাধান্য রক্ষার্থে আপ্রাণ চেষ্টা তো করিলেনই, উপরন্তু স্বদলের পুষ্টি সাধনে যত্নবান হইলেন। এইরূপে মালেকী ও হাম্বলী সকলেই সকলের ভক্তিভাজন ইমাম লইয়া যেমন তুষ্ট, তেমনি তাহাদের প্রাধান্য ও গৌরব রক্ষার জন্য ও তাহাদের দলের পুষ্টি সাধনে সততই ব্যতিব্যস্ত রহিলেন। কেহ কাহারো ইমামের যেমন ধার ধারিল না, তেমনি কোন দলের পরোয়াও করিল না।

এক্ষণে ইহারা সেই আদি আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত তথা আহলেহাদীছ দল হইতে ক্রমাগত বহির্গত হইয়া আসিতে থাকায়, উক্ত আদি দলটি যেমন সংখ্যা লঘিষ্ঠ ও দুর্বল হইয়া পড়িতে লাগিল, এই নবগঠিত দলগুলিও তেমনি শনৈঃ শনৈঃ পরিপুষ্ট হইতে লাগিল।  এই নবগঠিত দলগুলির কোন কোন কার্যে তাহাদের সহানুভূতি না থাকায় বরং বিরোধিতা করায় বিশেষ করিয়া এই নব দলগুলির কোন দলে যোগদান না করায়, শুধু যে ইহাদের বিরাগভাজন হইলেন তাহা নহে, বরং ইহাদের পক্ষ হইতে অন্যায় ও অসংগত ভাবে ‘লা-মাযহাবী’ উপাধিও লাভ করিলেন। তাই দুনিয়ার লোক বিচার-বিবেচনা না করিয়া উক্ত গরিষ্ঠ দলগুলির সুরে সুর মিলাইয়া আদি আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত তথা আছহাবুল হাদীছ বা আহলেহাদীছ দলটিকে গায়ের জোরে অন্যায় ভাবে ‘লা-মাযহাবী’ বলিয়া ফেলিলেন ও আজ পর্যন্ত বলিয়া চলিয়াছেন।

প্রিয় বিচক্ষণ পাঠক! আমরা কিন্তু স্পষ্টই উপরে দেখিয়া আসিয়াছি যে, উক্ত আছহাবুল হাদীছ দল হইতেই এই নবগঠিত দলগুলি বাহির হইয়া আসার দরুন, উহা ক্ষুদ্র ও লঘিষ্ঠ হইয়া পড়িলেও কদাচ লা-মাযহাবী নহেন। বরং উহারাই হইতেছেন খাঁটি, আদি, অখন্ড ও অবিভক্ত আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত বা ‘আহলেহাদীছ’ দল। অতঃপর উপরোক্ত দল চতুষ্টয় যখন নিজ নিজ অনুসরণীয় ইমামগণের দিকে সম্বন্ধ করিয়া নিজদিগকে নূতন ভাবে হানাফী, শাফেঈ ইত্যাদি নামে অভিহিত করিতে লাগিলেন, নিরূপায় হইয়া উক্ত আদি ও লঘিষ্ঠ দলটিও আবশ্যক বোধে নিজেদের অতি গৌরবের পরম মোক্তাদা সরওয়ারে  কায়েনাত হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (ছাঃ)-এর দিকে সভক্তি সম্বন্ধ করতঃ নিজদিগকে ‘মুহাম্মাদী’ বলিয়া পরিচয়  প্রদান করিতে বাধ্য  হইলেন। তাহারা একমাত্র  কুরআন ও হাদীছের অনুসারী হিসাবে যেমন পূর্বেও আছহাবুল হাদীছ বা আহলেহাদীছ- এই গৌরবান্বিত নামে অভিহিত ছিলেন, আজও সেই গৌরব রক্ষার্থে নানা লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্য দিয়াও নিজদিগকে ‘আহলেহাদীছ’ বলিয়া পরিচয় দিয়া আসিতেছেন।

এক্ষণে আমি ইহাদের আক্বীদা বা ধর্ম বিশ্বাস যে কি, তাহার সঠিক পরিচয় দিবার মানসে ‘মাযহাবে আহলেহাদীছ’ নামে এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাখানা আমার সহৃদয় পাঠক-পাঠিকার খেদমতে উপহার প্রদান করিতেছি। ইহা পাঠে তাহারা দেখিবেন যে, ইহাদের আক্বীদা আর অধুনা আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আতের দাবীদার উপরোক্ত নবদল চতুষ্টয়ের আক্বীদা প্রায় অভিন্ন। আর ইহারা হইতেছেন সত্যসত্যই সেই কুরূনে ছালাছার অখন্ড ও অবিভক্ত আহলে-সুন্নত ওয়াল-জামা‘আত আছহাবুল হাদীছ দল এবং প্রিয় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের একান্ত অনুরক্ত মুসলমান। উপরোক্ত দল চতুষ্টয় এই অখন্ড দল হইতেই বহির্গত হইয়া, নূতন নামে পরিচিত হইয়াছেন ভিন্ন অন্য কিছুই নহেন।

অতঃপর যে সমস্ত মহাপ্রাণ মহাজনগণের অনুপ্রেরণায় এই পুস্তিকা প্রকাশে সামর্থ্য লাভ করিয়াছি, তাহাদের প্রতি আমার হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশের শ্রদ্ধাপূর্ণ অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছি। এক্ষণে নগণ্য লেখকের এই ক্ষুদ্র   পুস্তিকাখানি বাংলাভাষী মুসলমানের ঘরে ঘরে প্রিয় ভাই-বোনের হস্তে দেখিতে পাইলে এবং ইহা পাঠে তাহাদের ভ্রান্ত ধারণার নিরসন হইলে, আমার সকল শ্রম সফল হইল মনে করিব।

হে আল্লাহ[2]! অযোগ্যের এই অকিঞ্চিৎকর খেদমতটুকু গ্রহণপূর্বক তাহার ও তদীয় পরলোকগত পিতা-মাতার নাজাতের পথ মুক্ত করুন- আমীন!

                                                                                                                                                                            

বিনীত

গ্রন্থকার


[1]. রাফেযীরাও মূলতঃ শী‘আ দলভুক্ত। -প্রকাশক

[2]. মাননীয় লেখক সে যুগের প্রচলন অনুযায়ী অনেক স্থানে ‘খোদা’ ও ‘নামায’ লিখেছেন। আমরা তার বদলে ‘আল্লাহ’ ও ‘ছালাত’ লিখলাম। -প্রকাশক।