আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?

মুজতাহিদগণের বিভক্তি (انقسام المجتهدين)

হিজরী ষষ্ঠ শতকের খ্যাতনামা বিদ্বান আবুল ফাৎহ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী (৪৭৯-৫৪৮ হিঃ) বলেন,

ثُمَّ الْمُجْتَهِدُوْنَ مِنْ أَئِمَّةِ الْأُمَّةِ مَحْصُوْرُوْنَ فِيْ صِنْفَيْنِ لاَ يَعْدُوَانِ إِلَى ثَالِثٍ : أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ أَصْحَابُ الرَّأْىِ، أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ وَ هُمْ أَهْلُ الْحِجَازِ ... وَ إِنَّمَا سُمُّوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ لِأَنَّ عِنَايَتَهُمْ بِتَحْصِيْلِ الْأَحَادِيْثِ وَ نَقْلِ الْأَخْبَارِ وَ بِنَاءِ الْأَحْكَامِ عَلَى النُّصُوْصِ وَ لاَيَرْجِعُوْنَ إِلَى الْقِيَاسِ الْجَلِىِّ وَ الْخَفِىِّ مَا وَجَدُوْا خَبَرًا أََوْ أَثَرًا ... وَ أَصْحَابُ الرَّأْىِ وَهُمْ أَهْلُ الْعِرَاقِ هُمْ أَصْحَابُ أَبِىْ حَنِيْفَةَ النُّعْمَانِ بْنِ الثَّابِتِ ... وَ إِنَّمَا سُمُّوا أَصْحَابَ الرَّأْىِ لِأَنَّ أَكْثَرَ عِنَايَتِهِمْ بِتَحْصِيْلِ وَجْهِ الْقِيَاسِ وَالْمَعْنَى الْمُسْتَنْبَطِ مِنَ الْأَحْكَامِ وَ بِنَاءِ الْحَوَادِثِ عَلَيْهَا وَ رُبَّمَا يُقَدِّمُوْنَ الْقِيَاسَ الْجَلِىَّ عَلَى آحَادِ الْأَخْبَارِ-

‘উম্মতের মুজতাহিদ ইমামগণ দু’ভাগে বিভক্ত, তৃতীয় কোন ভাগে নয়। আছহাবুল হাদীছ ও আছহাবুর রায় (আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়)। আহলুল হাদীছগণ হেজায (মক্কা-মদীনা)-এর অধিবাসী। তাঁদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ এ জন্য বলা হয় যে, তাঁদের সার্বিক লক্ষ্য নিয়োজিত থাকে হাদীছ সংগ্রহের প্রতি এবং তাঁরা সমস্ত আদেশ-নিষেধের ভিত্তি রাখেন (কুরআন-হাদীছের) দলীল সমূহের উপরে। হাদীছ বা আছার পেলে তাঁরা কোন প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য ক্বিয়াসের দিকে ফিরে তাকান না...। পক্ষান্তরে আহলুর রায়গণ হ’লেন ইরাকের অধিবাসী। তাঁরা আবু হানীফা নু‘মান ইবনু ছাবিত (৮০-১৫০ হিঃ)-এর অনুসারী। তাঁদেরকে ‘আহলুর রায়’ এ জন্য বলা হয়ে থাকে যে, তাঁদের অধিকতর লক্ষ্য থাকে ক্বিয়াসের কারণ অনুসন্ধানের প্রতি ও কুরআন-হাদীছের আহকাম হ’তে সৃষ্ট মর্মার্থের প্রতি এবং তার উপরেই তাঁরা উদ্ভূত ঘটনাসমূহের ভিত্তি স্থাপন করেন। কখনো কখনো তাঁরা ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছের উপরে প্রকাশ্য ক্বিয়াসকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন’।[1]

আহলুল হাদীছের নীতির সপক্ষে মত প্রকাশ করতে গিয়ে হিজরী পঞ্চম শতকের ইউরোপীয় বিদ্বান স্পেনের মুহাম্মাদ আলী ইবনু হায্ম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, ‘ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন-এর প্রথম হ’তে শেষ পর্যন্ত সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত বা ইজমা এই যে, তাঁদের কোন একজন ব্যক্তির সকল কথার প্রতি কর্ণপাত করা চলবে না। অতএব ঐ ব্যক্তি জেনে রাখুক, যে ব্যক্তি আবু হানীফার সকল কথা গ্রহণ করেছে, কিংবা মালেক, শাফেঈ বা আহমাদের সকল কথাকে গ্রহণ করেছে। তাঁদের কোন কথা ছাড়েনি বা অন্যের কথার প্রতি দৃকপাত করেনি, কুরআন ও সুন্নাহ্র আদেশ-নিষেধের প্রতিও ভ্রুক্ষেপ করেনি, ঐ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ইজমায়ে উম্মতের বিরোধিতা করেছে। এ নীতির অনুসারী কোন লোক ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের তিনটি প্রশংসিত যুগে ছিল না। ঐ ব্যক্তি মুমিনদের গৃহীত পথের বাইরে গিয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ঐ অবস্থা হ’তে পানাহ দিন’।[2]

এক্ষণে আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে আমরা আল্লাহ-প্রেরিত ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে জীবন সমস্যার সমাধান নেব? না মানব রচিত ফিক্বহের ভিত্তিতে সমাধান নেব। আমরা বুখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ, নাসাঈকে অগ্রাধিকার দেব? নাকি পরবর্তীতে সৃষ্ট একটি নির্দিষ্ট মাযহাবী ফিক্বহগ্রন্থ কুদূরী, শরহে বেকায়া, হেদায়াহ, আলমগীরীকে অগ্রাধিকার দেব। আমরা কি হাদীছপন্থী হব, নাকি রায়পন্থী হব? জানা আবশ্যক যে, নবীদের আগমন শেষ হয়ে গেছে, অহি-র অবতরণ বন্ধ হয়ে গেছে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোন পরিবর্তন নেই। কিন্তু যুগে যুগে ‘রায়’-এর পরিবর্তন ঘটেছে, আজও ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। বর্তমানে মুসলিম তরুণ সমাজ ক্রমেই বিজাতীয়দের রায়ের অনুসারী হয়ে পড়ছে। ফলে নানা মুণীর নানা মতে মুসলিম সমাজ আজ শতধা বিভক্ত। বিশৃংখল এই বিরাট উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ ও কল্যাণমুখী করার একটাই মাত্র পথ। সেটা হ’ল, সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ্র দিকে ফিরে চলা। পবিত্র কুরাআন ও ছহীহ হাদীছের ফায়ছালার সম্মুখে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা। যুগ যুগ ধরে আহলেহাদীছ আন্দোলন এই কল্যাণ লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়ে এসেছে, আজও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ।


[1]. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম শহরস্তানী, কিতাবুল মিলাল ওয়ান নিহাল (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ২০৬-২০৭ পৃঃ।

[2]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (মিসরী ছাপা ১৩২২ হিঃ) ১/১২৩-১২৪ পৃঃ।