সূদ

অন্যান্য ধর্ম, দর্শন ও সাহি’ত্যে সূদ

কুরআন নাযিলের পূর্বে অন্যান্য যেসব আসমানী গ্রন্থ নাযিল হয়েছিল, সেসবেও সূদ নিষিদ্ধ ছিল। ঐসব গ্রন্থ আজ আর অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায় না। একমাত্র আল-কুরআনই রয়েছে অবিকৃত অবস্থায়, থাকবেও ক্বিয়ামত পর্যন্ত। কারণ আল্লাহ রাববুল আলামীন স্বয়ং এর হেফাযতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। দাঊদ (আঃ)-এর উপর নাযিলকৃত গ্রন্থ ‘যাবূর’-এর কোন সন্ধান মেলে না। মূসা (আঃ)-এর উপর নাযিল হওয়া ‘তাওরাত’ ও ঈসা (আঃ)-এর উপর নাযিল হওয়া ‘ইনজীল’-এর যে বহু বিকৃতি ঘটানো হয়েছে যুগে যুগে, একথা তো সর্বজনবিদিত। তারপরও ইনজীল বা বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ বা আদিপুস্তক তাওরাতেরই অংশবিশেষ বলে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞগণ দাবী করেন। সেই আদিপুস্তকেই সূদ সম্বন্ধে যে ঘোষণা ও নির্দেশনা রয়েছে তা এ যুগের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। উদাহরণত-

(১) ‘তুমি যদি আমার প্রজাদের মধ্যে তোমার স্বজাতীয় কোন দীন-দুঃখীকে টাকা ধার দাও তবে তাহার কাছে সূদগ্রাহীর ন্যায় হইও না; তোমরা তাহার উপর সূদ চাপাইবে না’ [(Exodus) যাত্রাপুস্তক;  ২২: ২৬]

(২) ‘তুমি তাহা হইতে সূদ কিংবা বৃদ্ধি লইবে না, কিন্তু আপন ঈশ্বরকে ভয় করিবে... তুমি সূদের জন্য তাহাকে টাকা দিবে না’ [(Leviticus) লেবীয় পুস্তক, ২৫: ৩৬-৩৭]

(৩) ‘তুমি সূদের জন্য, রৌপ্যের সূদ, খাদ্য সামগ্রীর সূদ, কোন দ্রব্যের সূদ পাইবার জন্য আপন ভ্রাতাকে ঋণ দিবে না’ [(Deuteronomy) দ্বিতীয় বিবরণ, ২৩: ১৯]

(৪) ‘যে সূদ ও বৃদ্ধি লইয়া আপন ধন বাড়ায়... তাহার প্রার্থনাও ঘৃণাস্পদ’ [(Ecclesiastes) হি’তোপদেশ, ২৮: ৮-৯]

(৫) ‘যে সূদের জন্য টাকা ধার দেয় না... সে কখনও বিচলিত হইবে না’ [(The Psalm) গীতসংহিতা, ১৫: ৬]

(৬) ‘পরন্তু কোন ব্যক্তি যদি ধার্মিক হয়... সূদের লোভে ঋণ দেয় নাই, কিছু বৃদ্ধি লয় নাই... তবে সেই ব্যক্তি ধার্মিক, সে অবশ্য বাঁচিবে’ [(Ezekiel) যিহিস্কেল, ১৮: ৮-৯]

(৭) ‘যদি সূদের লোভে ঋণ দিয়া থাকে ও বৃদ্ধি লইয়া থাকে তবে সে কি বাঁচিবে? সে বাঁচিবে না; সে এই সকল ঘৃণার্হ কার্য করিয়াছে’ [(Ezekiel) যিহিস্কেল, ১৮: ৯৩]

খৃষ্টধর্মের শুরু হ’তে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা এবং রোমে পোপের নিয়ন্ত্রিত চার্চ হ’তে অন্যান্য চার্চের বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত সূদ নিষিদ্ধ ছিল। সকল চার্চই তখন এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করত। মধ্যযুগে ইউরোপের চার্চ অপরিসীম লোভ ও কৃপণতার জন্য সূদখোরদেরকে দেহপসারিণীদের সমতুল্য গণ্য করেছিল।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রখ্যাত দার্শনিক ও সমাজহিতৈষী ব্যক্তিগণও সূদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা সূদের অশুভ পরিণতি তুলে ধরেছেন এবং সূদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছেন। এ্যারিস্টটল তাঁর Politics গ্রন্থে সূদকে কৃত্রিম  মুনাফা আখ্যায়িত করে বলেছেন যে, অন্যান্য পণ্যের ন্যায় অর্থ ক্রয়-বিক্রয় করা এক ধরনের জালিয়াতি। সুতরাং, সূদের কোন বৈধতা থাকতে পারে না। প্লেটো তাঁর Laws নামক গ্রন্থে সূদের নিন্দা করেছেন।  থমাস একুইনাস সূদের বিরুদ্ধে যুক্তি  দিয়ে বলেছেন, অর্থ থেকে অর্থের  ব্যবহারকে পৃথক করা যায় না। অর্থের ব্যবহার করা মানে অর্থ খরচ করে ফেলা। এক্ষেত্রে একবার অর্থের ব্যবহারের মূল্য নেয়ার পর অর্থাৎ মুনাফা গ্রহণের পর পুনরায় অর্থের মূল্য নেওয়া হলে একই দ্রব্য দু’বার বিক্রি করার অপরাধ হবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অবিচার’। সূদকে সময়ের মূল্য বলে যারা দাবী করেন তাদের যুক্তি খন্ডন করে তিনি বলেন, সময় এমন এক সাধারণ সম্পদ যার উপর ঋণগ্রহীতা, ঋণদাতা ও অন্যান্য সকলেরই সমান মালিকানা বা অধিকার রয়েছে। এ অবস্থায় শুধু ঋণদাতার সময়ের মূল্য দাবী করাকে তিনি অসাধু ব্যবসা বলে অভিহিত করেছেন। হিন্দু ধর্মেও সূদ গ্রহণকে সমর্থন করা হয়নি (মনুসংহিতা, ৮ম অধ্যায়, শ্লোক নং ১০২)। বৃহদ্ধর্ম পুরানৈত্ত সূদকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে (উত্তর খন্ড, শ্লোক নং ৬৩)

পুঁজিবাদের কঠোর সমালোচক এবং সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক প্রবক্তা কার্ল মার্কসও সূদ ও সূদখোরদের তীব্র ও তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছেন (দ্রঃ Capital. Vol. 2)। তিনি অর্থনীতি হ’তে সূদ উচ্ছেদ, সূদখোরদের কঠোর শাস্তি প্রদান ও তাদের সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। অর্থ বা মুদ্রাকে তিনি সমাজ শোষণের হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করেছেন। এজন্য সোভিয়েত রাশিয়ায় কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্বে যুদ্ধ সাম্যবাদ চলাকালীন সময়ে (১৯১৮-২২) পুঁজিবাদী অর্থনীতি উৎখাতের অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল পর্যন্ত অর্থনৈতিক লেনদেন হ’তে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল।[1]

পল মিলস ও জন প্রিসলে বলেন, ইতিহাসের কালপরিক্রমায় দেখা যায় অন্যের দুর্ভাগ্য হ’তে ‘মুনাফা’ অর্জনের জন্য ইহুদী সূদখোরদের নিন্দা করা হয়েছে। প্লুটার্ক বিশ্বাস করতেন বিদেশী আক্রমণকারীদের চাইতে অর্থ ঋণদানকারীরা অধিক নির্যাতনকারী। সূদখোররা তাদের প্রবাদতুল্য অর্থগৃধণ ুতা, নিষ্ঠুরতা ও অর্থলোলুপতার জন্য বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকদের রচনায় বিদ্রূপের খোরাক হয়ে রয়েছে। ইতালীর অমর কবি দান্তে সূদখোরদের নরকের অগ্নিবৃষ্টিময় সপ্তম বৃত্তে নিক্ষেপের কথা বলেছেন।  ইংরেজী সাহি’ত্যের অবিসংবাদিত সম্রাট সেক্সপীয়রের দি মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকের শাইলক ও মলিয়েরর দি মাইজার নাটকের হারপাগণের নাম কে না শুনেছে? বাংলা সাহি’ত্যেও গল্প-উপন্যাসে সূদখোরদের শোষণ-পীড়নের কাহিনীর উল্লেখ একেবারে অপ্রতুল নয়। রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা, শওকত ওসমানের ইতা প্রভৃতি গল্প এবং কাজী ইমদাদুল হকের আব্দুল্লা, অদ্বৈত মল্ল বর্মনের তিতাস একটি নদীর নাম প্রভৃতি উপন্যাস তার প্রমাণ।


[1]. বিস্তারিত দ্রষ্টব্য E.H. Carr- The Bolshevik Revolution, Vol. 2, Ch. 17; Macmillan, 1952.