সূদ

উপসংহার

আশা করা যায়, উপরে আলোচিত উপায়সমূহ অনুসরণ ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এদেশে সূদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি সম্ভব। এর ফলে আল্লাহ রাববুল আলামীন ঘোষিত হারাম বর্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস সূচিত হবে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মন-মানসিকতা প্রবলভাবে ইসলামমুখী। পক্ষান্তরে বিদ্যমান আইন-কাঠামো, সামাজিক আচরণ, এমনকি ব্যবসায়ীদের অধিকাংশেরই চিন্তা-চেতনা ইসলামী ঈমান-আক্বীদার সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে সমাজে বিরাজমান রয়েছে এক বিষম অবস্থা।

আজও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও রোমান-বৃটিশ আইন দ্বারা এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিয়ন্ত্রিত। এই প্রতিকূল অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখেই বলা যায়, সূদ বর্জন ও উচ্ছেদের জন্য যেমন একদিকে চাই ঈমানের জোর ও সূদের নানামুখী ধ্বংসাত্মক কুফল সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান, অন্যদিকে তেমনি চাই সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। সূদ উচ্ছেদ ও বর্জনের কৌশল হিসাবে যেসব উপায়ের আলোচনা করা হয়েছে সেগুলিই শেষ কথা নয়, আরও উপযুক্ত পথ বা কৌশল উদ্ভাবিত হ’তে পারে। কিন্তু কাগজের পাতাতেই  এসব  কৌশল  আবদ্ধ  থাকলে  কোন  সুফল  আসবে না। বরং বাস্তবায়নযোগ্য একটি এ্যাকশন প্ল্যান রচনা করে সেই অনুযায়ী ধীর অথচ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেলে আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তিরও আশা করা যায়।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, উমাইয়া ও আববাসীয় খিলাফতের সময় মুসলিম বিশ্বের কোথাও সূদ চালু ছিল না। সেই সময়েও মুসলিম ব্যবসায়ীরা বিশাল মাপের আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করেছে। সুদূর চীনের জিনজিয়াং এলাকা হ’তে স্পেনের আন্দালুসিয়া, কর্ডোভা কিংবা আফ্রিকার জাঞ্জিবার পর্যন্ত বাণিজ্য সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় করেছে, পণ্যদ্রব্যের পসরা নিয়ে বসেছে নগরে-বন্দরে। কিভাবে সে সময়ে তাদের মূলধনের প্রয়োজন পূরণ হ’তো? কিভাবে তারা শারী‘আর শর্ত পালন করে ব্যবসায়িক লেনদেন করতো?

এর উত্তর হ’ল সেই সময়ে তারা মুযারাবা, মুশারাকা, বায়য়ে সালাম, বায়য়ে মুয়াজ্জাল, মুরাবাহা, ইসতিসনা, কেরায়া, জু‘আলাহ, ইজারা, ইজারা বিল বায়য়ে, শিরকাতুল মিলক্ ইত্যাদি দশ/বারোটি পদ্ধতি ব্যবহার করতো। ফলে তাদের কখনই সূদের ভিত্তিতে অর্থ লেনদেনের প্রয়োজন হয়নি। আধুনিককালে দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকগুলো এসব পদ্ধতিই ব্যবহার করে চলেছে তাদের আমানত বিনিয়োগ ও মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে। এ কাজে ইতিমধ্যেই তাদের অর্জিত সফলতা রীতিমতো ঈর্ষণীয়।

বস্ত্ততঃ অর্থনীতি সূদবিহীন হ’লে বিনিয়োগের জন্য যেমন অর্থের অব্যাহত চাহিদা থাকবে তেমনি সঞ্চয়েরও সদ্ব্যবহার হবে। এর ফলে নতুন নতুন কল-কারখানা স্থাপন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে অধিক উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও সম্পদের সুষম বণ্টন ঘটবে। প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। একচেটিয়া কারবার হরাস পাবে। অতি মুনাফার সুযোগ ও সমাজ স্বার্থবিরোধী বিনিয়োগ বন্ধ হবে। এই সমস্ত উদ্দেশ্য সাধন ও বড় ধরনের শোষণের পথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্যই ইসলাম সূদকে হারাম বা অবৈধ ঘোষণা করেছে। বস্ত্ততঃ যুলুম ও বঞ্চনার অবসান ঘটাতে হ’লে তার উৎসকেই সমূলে বিনাশ করতে হবে। সেটাই বৈজ্ঞানিক পন্থা। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,  نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيْبٌ (নাছরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন ক্বারীব) (আছ ছফ ৬১/১৩)। তবে সেজন্য নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। এক অর্থে সূদ উচ্ছেদ একটি জিহাদ। তাই এজন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্ত্তত থাকতে হবে। তবেই সূদের ভয়াবহ যুলুম হ’তে মানবতা মুক্তি পাবে। হালাল রিযিক প্রাপ্তির মাধ্যমে দো‘আ কবুলের বদৌলতে আল্লাহর সাহায্য ও ক্ষমা লাভের সুযোগ হবে। একই সাথে ইহলৌকিক কল্যাণের পাশাপাশি পারলৌকিক সাফল্যও নিশ্চিত হবে।