সূদ

নৈতিক ও সামাজিক কুফল

১। সূদ সমাজ শোষণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম :

একদল লোক বিনাশ্রমে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসায় সূদের সাহায্যেই। ঋণগ্রহীতা যে কারণে টাকা ঋণ নেয় সে কাজে তার লাভ হোক বা না হোক তাকে সূদের অর্থ দিতেই হবে। এর ফলে অনেক সময় ঋণ গ্রহীতাকে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে হ’লেও সূদসহ আসল টাকা পরিশোধ করতে হয়। পরিণামে সে আরও দরিদ্র হয়। সমাজে শ্রেণীবৈষম্য আরও বৃদ্ধি পায়। বস্ত্ততঃ সূদ গ্রহীতারা সমাজের পরগাছা। এরা অন্যের উপার্জন ও সম্পদে ভাগ বসিয়ে জীবনযাপন করে। উপরন্তু বিনাশ্রমে অর্থ লাভের ফলে সমাজের প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এদের কোন অবদান থাকে না।

২। সূদ মানুষকে স্বার্থপর ও কৃপণ বানায় :

অর্থলিপ্সা, কার্পণ্য ও স্বার্থপরতা সূদখোরদের কতিপয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিনাশ্রমে উপার্জনের আকাঙ্খা ও অর্থলিপ্সা হ’তেই সূদ প্রথার জন্ম। সূদের মাধ্যমে নিশ্চিত ও নির্ধারিত আয় প্রাপ্তির লোভ সূদখোরদের বিচার-বিবেচনা, আবেগ-অনুভূতি এমনকি বিবেককে পর্যন্ত নিঃসাড় করে দেয়। সূদখোরদের মধ্যে লোভ ও স্বার্থপরতা ক্রমে ক্রমে এতদূর প্রসার লাভ করে, তাদের আচার-আচরণের এতখানি পরিবর্তন ঘটে যে, তারা হয়ে ওঠে সমাজের পরিহাসের পাত্র। তাদের প্রবাদতুল্য লোভ, পরের সম্পদ ও বিত্ত গ্রাসের প্রবণতা গল্প-কাহিনীর খোরাক হয়ে ওঠে। ইতিপূর্বে সেসব উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। যারা সূদ দিতে সক্ষম তাদের জন্য মহাজন ও সূদী ব্যাংকগুলো এগিয়ে আসে ঋণের পসরা নিয়ে। কিন্তু যারা সূদ দিতে অপারগ তাদের পক্ষে ঋণ পাওয়া তো দূরের কথা, অনেক সময়ে মৌখিক সহানুভূতিটুকু পাওয়াও হয়ে ওঠে না।

৩। সূদ শ্রমবিমুখতা ও অলসতা সৃষ্টি করে :

সূদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে কোন পরিশ্রম ও ঝুঁকি ছাড়াই সূদের মাধ্যমে নির্ধারিত হারে অর্থ পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থা যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রতিভাবান ও কর্মঠ লোককেও অকর্মণ্য ও অলস বানিয়ে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা স্থাপন অর্থাৎ উৎপাদনধর্মী কাজে যে চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও ঝুঁকি গ্রহণের দরকার সূদভিত্তিক সঞ্চয়কারীরা তা আর করে না। বরং ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ হ’তে বিনাশ্রমে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত হারে আয় পেয়ে তারা পরিতৃপ্ত থাকে। ধীরে ধীরে আলস্য তাদের গ্রাস করে। এভাবে সূদের কারণেই যাদের হাতে অঢেল বিত্ত রয়েছে তাদের শ্রম, মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার ফসল হ’তে সমাজ বঞ্চিত হয়। সৃষ্টি হয় শ্রমবিমুখতা ও অলসতা। এদেশের সাহি’ত্যে এর ভুরি ভুরি নজীর মিলবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান সূদী ব্যবস্থায় কেউ ব্যাংকে দশ লাখ টাকা মেয়াদী জমা রেখে কোন রকম শ্রম, ঝুঁকি বা দুশ্চিন্তা ছাড়াই ঘরে বসে প্রতি মাসে ন্যূনতম দশ হাযার টাকা পেতে পারে।

৪। সূদ স্বল্প লাভজনক সামাজিক প্রয়োজনীয় খাতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে :

সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, তা উৎপাদনমুখীই হোক আর সেবামূলকই হোক, একই হারে মুনাফা হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে মুনাফার হার সূদের হারের চেয়ে বেশী, কোথাও সমান, আবার কোথাও বা কম। সাধারণভাবে বিলাস সামগ্রী ও সমাজের জন্যে অকল্যাণকর খাতে উৎপাদন ও ব্যবসায়ে মুনাফার হার হয়ে থাকে সর্বোচ্চ। প্রসাধনী ও বিলাস সামগ্রী, সৌখিন দ্রব্য, মদ ও নেশার বস্ত্ত এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পক্ষান্তরে সমাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ও কল্যাণকর দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার ক্ষেত্রে মুনাফার হার প্রায়শঃই খুব কম হয়ে থাকে। এমনকি তা প্রদেয় সূদের হারের চেয়েও কম হ’তে পারে। ফলে সূদভিত্তিক অর্থনীতিতে যেখানে মুনাফার হার সূদের হারের চেয়ে বেশী সেখানেই বিনিয়োগ হয় সর্বাধিক। অপরদিকে যেসব অত্যাবশ্যকীয় খাতে মুনাফার হার সূদের হারের সমান বা কম সেখানে কোন বিনিয়োগকারী এগিয়ে আসতে আগ্রহী হয় না। কারণ গৃহীত ঋণের সূদ প্রদানের পর উদ্যোক্তার আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। পরিণামে সামাজিকভাবে কাম্য সেবা ও দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদন ও সরবরাহে সংকোচন ঘটে অনিবার্যভাবেই। অথচ সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে এই খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে যরূরী। যদি অর্থনীতিতে সূদ না থাকতো তাহ’লে বিনিয়োগকারীরা (এবং মূলধনের যোগানদারেরাও) প্রাপ্তব্য মুনাফাতেই (তার হার যত কমই হোক না কেন) পুঁজি বিনিয়োগে দ্বিধা করতো না। ফলে সমাজের অপরিহার্য ও কল্যাণকর খাতের সম্প্রসারণ ও কর্মোদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হ’ত।

৫। সূদ নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ :

সূদভিত্তিক অর্থনীতিতে নিশ্চিত আয়ের অর্থাৎ অবধারিতভাবে সূদ প্রাপ্তির লোভে অনৈতিক ও অনৈসলামী কাজে মূলধন বিনিয়োজিত হয়। উদাহরণস্বরূপ মদের ব্যবসা, ফটকাবাজারী, মজুতদারী, অনৈতিক ও কুরুচিপূর্ণ গান-বাজনা, সিনেমা, এমনকি পর্ণোগ্রাফির মতো বিষয়ে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে। এসব কাজে যেহেতু মুনাফা অর্জিত হয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী হারে, সেহেতু প্রদেয় সূদ পরিশোধের পরও বিস্তর মুনাফা থেকে যায় উদ্যোক্তার হাতে। তাই তার পক্ষে চড়া হারেও সূদ পরিশোধ করা আদৌ কঠিন নয়। এই পথ ধরে সমাজে অনৈতিক ও অসামাজিক কাজের প্রসার ঘটে সহজেই। পরিণামে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী ও কিশোর-কিশোরীর সহজাত বোধ-বিশ্বাসে চিড় ধরে। ধীরে ধীরে তাদের ঈমানী চেতনার বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করে। ক্রমেই মূল্যবোধের ক্ষয় হয় এবং প্রায় অলক্ষ্যেই সমাজে নৈতিক অধঃপতন গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসে। সমাজের অবক্ষয় তথা ধ্বংস হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী ও অপ্রতিরোধ্য। বস্ত্ততই মুনাফার হার তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার কারণে সমাজ হিতকর ও কল্যাণধর্মী প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্যে পুঁজি সংগ্রহ করা বর্তমান সময়ে অতীব দুরূহ কাজ।

৬। সূদ সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে :

সূদখোর মহাজন ও পুঁজিপতিরা তাদের প্রদত্ত ঋণের বিনিময়ে হাযার হাযার লোকের কঠোর শ্রমের ফসলে অন্যায্য ভাগ বসায়। শুধু তাই নয়, অনুৎপাদনশীল কাজের জন্য গৃহীত ঋণের বিপরীতে যেহেতু কোন বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই সেহেতু এই ঋণ পরিশোধ করতে ঋণগ্রহীতাদের সহায়-সম্পত্তির উপরেও চাপ পড়ে অনিবার্যভাবেই। এমনকি ঋণের দায়ে অনেকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক হয়, পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ওঠে নিলামে। মানুষের আপদকালে দাবীকৃত বাড়তি এই অর্থ অর্থাৎ সূদ তাই স্বভাবতই ঋণ গ্রহীতাদের সংক্ষুব্ধ করে তোলে। মানুষ তাদেরকে বিপদের দিনে দাতা মনে করার পরিবর্তে রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারই মনে করে। এরা হয়ে ওঠে সমাজে ঘৃণার পাত্র।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান না থাকায় বাইতুল মাল হ’তে সাহায্য বা করযে হাসানা পাওয়ার কোন সুযোগ না থাকায় সূদভিত্তিক ঋণ নিতে বাধ্য হয় সমস্যাগ্রস্ত অসহায় নারী-পুরুষ। উপরন্তু সূদখোররা গরীব ও অসহায় কৃষকদের জমি-জিরাত ঋণের দায়ে দখল করে, ফসলের সূদ খেয়ে খেয়ে ধীরে ধীরে ফুলে ফেঁপে ওঠে, হয়ে ওঠে বিপুল সম্পদের মালিক। কখনও কখনও এমনও দেখা যায়, গৃহস্থ চাষী, ক্ষুদে খামারের মালিক সূদখোর মহাজনের ঐ জমিতে বর্গাচাষ করতে বাধ্য হচ্ছে একদিন যে জমির মালিক ছিল সে নিজেই। স্বভাবতই তখন তার মনে সৃষ্টি হয় বিদ্বেষ ও অসূয়ার যার পরিণাম ফল মোটেই শুভ নয়।

৭। সূদের কারণেই দরিদ্র আরও দরিদ্র এবং ধনী আরো ধনী হয় :

সূদের পরিণামে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য বেড়েই চলে। দরিদ্র অভাবগ্রস্ত মানুষ প্রয়োজনের সময়ে সাহায্যের কোন দরজা খোলা না পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। সেই ঋণ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় প্রকার কাজেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ফলে তার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাই লোপ পায়। পুঁজিবাদী সমাজে করযে হাসানার কোন সুযোগ না থাকায় অনুৎপাদনী খাতে ঋণ তো দূরের কথা, উৎপাদনী খাতেও বিনা সূদে ঋণ মেলে না। বোঝার উপর শাকের অাঁটির মতো তাকে সূদ পরিশোধ করতে হয়। এর ফলে সে তার শেষ সম্বল যা থাকে তাই বিক্রি করে উত্তমর্ণের ঋণ শুধরে থাকে। এই বাড়তি অর্থ পেয়ে উত্তমর্ণ আরো ধনী হয়। অধমর্ণ হয় আরও দরিদ্র। বৃদ্ধি পেতে থাকে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য।

বাংলাদেশে একশ্রেণীর ধনী যে আরও ধনী হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান কারণ সূদভিত্তিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণ দানের নীতি ও কৌশল। যোগ্যতা ও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় জামানত দিতে না পারার কারণে সূদী ব্যাংকগুলো হ’তে ঋণ পায় না, অথচ বিত্তশালী ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তারা সহজেই ঋণ পায়। ব্যাংক হাযার হাযার লোকের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে, কিন্তু ঐ অর্থ ঋণ আকারে পায় মুষ্টিমেয় বিত্তশালীরাই। এ থেকে উপার্জিত বিপুল মুনাফা তাদের হাতেই রয়ে যায়। ফলে সঞ্চয়কারী হাযার হাযার লোক তাদের অর্থের প্রাপ্য উচিত আয় থেকে বঞ্চিত হয়। বিত্তশালী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানসমূহকে যে সূদ পরিশোধ করে তা জনগণের কাছ থেকে সেবা ও দ্রব্যের মূল্যের সাথেই তুলে নেয়। ফলে ব্যাংকের দায় পরিশোধ করেও তাদের মুনাফার কোন কমতি হয় না, পরিণামে ধনীরা আরও ধনী হয়, গরীবরা হয় আরও গরীব। সমাজহিতৈষীরা তাই যতই ‘গরীবী হঠাও’ বলে চিৎকার করুক সূদের মতো এই দৃঢ়মূল, সুকৌশলী ও সর্বব্যাপী শোষণ প্রক্রিয়া বহাল থাকা অবস্থায় দারিদ্র্য দূরীকরণের কোন প্রেসক্রিপশনই কার্যকর হবে না।