সমাজ বিপ্লবের ধারা

জিহাদের প্রকৃতি

(كيفية الجهاد)

এদেশে ‘জিহাদ’ এবং ‘শহীদ’ শব্দ দু’টি স্থানে-অস্থানে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রত্যেক দলই নিজেদের দলীয় স্বার্থে কাজ করাকে ‘জিহাদ’ ভাবেন এবং অপর দলের হাতে তাদের দলের কোন কর্মী মারা গেলে তাকে ‘শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করেন। আসুন, আমরা এ বিষয়ে বর্তমান শতকের একজন মর্দে মুজাহিদ মিসরের সাইয়েদ কুতুব (১৯০৬-১৯৬৬ খৃঃ)-এর কাছ থেকে জওয়াব নিই। তিনি ‘মুমিনের সংগ্রাম রাজনৈতিক নয় বরং আক্বীদা ও বিশ্বাসের সংগ্রাম’- এ প্রসঙ্গে বলেন,১০

‘ঈমানদারগণ ও তাদের প্রতিপক্ষের মধ্যে যে সংগ্রাম অবিরতভাবে চলছে, এটা স্রেফ আক্বীদার সংগ্রাম, আদৌ অন্য কিছু নয়। তাদের শত্রুরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয় স্রেফ ঈমানের কারণে। তারা তাদের উপর ক্রুদ্ধ হয় স্রেফ আক্বীদার কারণে। এটি কোন রাজনৈতিক সংগ্রাম নয়, অর্থনৈতিক সংগ্রাম নয় বা কোন জাতি-গোষ্ঠীগত সংগ্রাম নয়। যদি এসবের সামান্য কিছুও হ’ত, তাহ’লে তা মিটানো সম্ভব হ’ত এবং তার সমাধান সহজ হ’ত।

১০. বর্ণনাটি নিম্নরূপ:

إن المعركة بين المؤمنين وخصومهم هى فى صحيحها معركة عقيدة وليست شيئا آخر على الإطلاق وان خصومهم لاينقمون منهم الا الايمان ولايسخطون منهم الا العقيدة- انها ليسة معركة سياسية ولا معركة اقتصادية ولا معركة عنصرية ولو كانت شيئا من هذا لسهل وقفها وسهل حل إشكالها ولكنها فى صحيحها معركة عقيدة، إما كفر وإما إيمان، إما جاهلية وإما إسلام- معالم فى الطريق، ط-بيروت ১৯৮৩ ص ২০১-

কিন্তু সঠিক কথা এই যে, এটি হ’ল আক্বীদা-বিশ্বাসের সংগ্রাম। হয় কুফর থাকবে, নয় ঈমান থাকবে। হয় জাহেলিয়াত থাকবে, নয় ইসলাম থাকবে’।১১ যদিও ইসলামের শত্রুগণ সর্বদা এ লড়াইকে অন্যভাবে রূপ দিতে চেষ্টা করে থাকে।

অতঃপর ‘শহীদ’ কে? সে বিষয়ে ওমর ফারূক (রাঃ) একদা খুৎবায় বলেন,

تقولون في مَغازِيْكم فلانٌ شهيدٌ ومات فلانٌ شهيدًا ... ألا لاتقولوا ذَلِكُمْ ولكن قولوا كما قال رسولُ الله صلى الله عليه وسلم : مَنْ مات في سبيل الله أو قُتِلَ فهو شهيدٌ، رواه أحمد بإسناد حسن-

‘তোমরা তোমাদের যুদ্ধ সমূহে বলে থাক, নিহত অমুক ব্যক্তি শহীদ বা মৃত অমুক ব্যক্তি শহীদ। ... তোমরা এরূপ বলো না। বরং ঐরূপ বল যেরূপ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করল অথবা নিহত হ’ল,  সে ব্যক্তি শহীদ’।১২  কেননা  কোন্ ব্যক্তি  কোন্ নিয়তে জিহাদ  করেছে, সে খবর একমাত্র আল্লাহ ভাল জানেন। খালেছ আল্লাহর ওয়াস্তে হওয়াটাই এখানে বড় কথা। দুনিয়াবী কোন স্বার্থে নয়।

বন্ধুগণ!

নবীগণের ইতিহাস স্মরণ করুন। তারা কারো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থে ভাগ বসাতে যাননি। তাঁদের আমলের প্রতিষ্ঠিত শাসন শক্তিকে উৎখাতের চেষ্টা করেননি। তাহ’লে কেন তখনকার সমাজ সর্বশক্তি নিয়ে তাঁদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? কেন তাঁদেরকে জীবন্ত করাতে চিরে হত্যা করেছিল? কেন জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে জীবন্ত নিক্ষেপ করেছিল? কেন আমাদের নবী (ছাঃ)-কে দেশ ছাড়তে হয়েছিল? কেন ‘আছহাবুল উখদূদ’কে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হ’ল?

জওয়াব আল্লাহর কাছ থেকেই নিন-

وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلاَّ أَنْ يُّؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْدِ-

১১. সায়েদ কুতুব, মা‘আলিম ফিত ত্বরীক্ব (বৈরুত ছাপাঃ ১৯৮৩), পৃঃ ২০১

১২. আহমাদ, হাদীছ হাসান; ফাৎহুল বারী ৬/১০৬ ‘জিহাদ’ অধ্যায় হা/২৮৯৮-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য

‘তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছিল কেবলমাত্র একটিই কারণে যে, তারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল, যিনি মহাপরাক্রান্ত ও চিরপ্রশংসিত’ (বুরূজ ৮৫/৮)

বলাবাহুল্য ঈমান ও কুফর, ইসলাম ও জাহেলিয়াত কখনো একত্রে বাস করতে পারে না। বর্তমানে মুসলিম সমাজে ব্যাপক অধঃপতনের মূল কারণ হ’ল জিহাদ বিমুখতা। আর জিহাদবিমুখতার প্রধান কারণ হ’ল আপোষকামিতা। তথাকথিত ‘হেকমতের’ দোহাই পেড়ে সর্বত্র জাহেলিয়াতের সংগে আমরা আপোষ করে চলেছি। কি আলেম কি সমাজনেতা সবাই যেন আমরা একই রোগে ভুগছি। আমরা আপোষ করেছি ধর্মীয় ক্ষেত্রে ‘তাক্বলীদে শাখছী’র সঙ্গে, যা কুরআন ও সুন্নাহর নিরপেক্ষ অনুসরণের ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বাধা। আমরা আপোষ করেছি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা, সামরিকতন্ত্র ও পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের সাথে- যা এলাহী সার্বভৌমত্বের সম্পূর্ণ বরখেলাফ। আমরা আপোষ করেছি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সাথে, যা ইসলামী অর্থনীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। আমরা আপোষ করেছি সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রসম-রেওয়াজের সঙ্গে, যা ইসলামী সংস্কৃতির সাথে অনেক ক্ষেত্রে বিরোধপূর্ণ।

বন্ধুগণ!

আমাদেরকে অবশ্যই আপোষকামী মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। যেমন করেছিলেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর মাক্কী জীবনে। জাহেলী সমাজে বাস করেও তিনি জাহেলিয়াতের সঙ্গে আপোষ করেননি। সমাজ তাঁকে একঘরে করেছে। তাঁর জন্য বাজার নিষিদ্ধ করেছে। গাছের ছাল-পাতা খেয়ে তিনি জীবন ধারণ করেছেন। তথাপি সমাজের সঙ্গে আপোষ করেননি। মর্মান্তিক অগ্নি পরীক্ষা সত্তেবও আপোষ করেননি পিতা ইবরাহীম (আঃ) তৎকালীন সমাজ ও সরকারের সাথে। শুধু পিতা ইবরাহীম কেন দুনিয়ার সকল নবীর ইতিহাস জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে আপোষহীন জিহাদের ইতিহাস। কোন নবীই স্বীয় জীবনে স্বীয় সমাজে মেজরিটির সমর্থন পাননি। এমনকি ক্বিয়ামতের দিন কোন কোন নবী মাত্র একজন উম্মত নিয়ে হাযির হবেন।১৩

১৩. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭৪৪।

সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন না পাওয়ার অর্থ কি তাঁরা বাতিলপন্থী ছিলেন? (নাঊযুবিল্লাহ)। তাঁরা ক্ষমতা ও পদমর্যাদার লড়াই করেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন আল্লাহর পাঠানো অভ্রান্ত সত্যকে সমাজের সামনে তুলে ধরতে। হক্ব-এর আওয়াযকে বুলন্দ করতে। বাতিলকে বাতিল হিসাবে চিহ্নিত করতে।

আমাদেরকেও নবীগণের পথ বেছে নিতে হবে। সে পথ ভোটারের মনস্ত্তষ্টির পথ নয়, সে পথ আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ। সে পথ শুধু চেয়ার পরিবর্তনের পথ নয়, সে পথ সমাজ পরিবর্তনের পথ, সমাজ বিপ্লবের পথ, আপোষহীন জিহাদের পথ।