ইনসানে কামেল

প্রত্যেকটি হক-এর যাহেরী ও বাত্বেনী দিক

প্রতিটি হক-এর জন্য যাহেরী ও বাত্বেনী দু’টি দিক রয়েছে। যেমন হাক্কুন নাফস আদায় করতে গিয়ে দেহের যাহেরী দিক ঠিক রাখার জন্য নিয়মিত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করা, দেহকে পরিচ্ছন্ন রাখা, কাপড়-চোপড় পরিস্কার রাখা, প্রয়োজনীয় ঔষধ সেবন করা, নিয়মিত নিদ্রা যাওয়া, ব্যায়াম করা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হয়। কেননা মূলত: দৈহিক সুস্থতার উপরেই বাকী দু’টি হক আদায় নির্ভর করে। সেজন্য ঘুমের কারণে হাক্কুল্লাহ ফরয ছালাত ছুটে গেলেও আল্লাহ নারায হন না। বরং তার ক্বাযা আদায় করলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। এতদ্ব্যতীত রোগী ও মুসাফিরের জন্য ফরয ছালাত ও ছিয়ামে রয়েছে ব্যাপক রেয়াত। সেকারণ দৈহিক স্বাস্থ্যের হেফাযত করা অতীব যরূরী বিষয়।

কিন্তু এর সাথে রয়েছে আরও একটি বিষয়, যা তদোধিক যরূরী। সেটি হ’ল মানসিক স্বাস্থ্যের হেফাযত। সদা মনমরা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তি কখনো সঠিক অর্থে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হ’তে পারে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে মানবদেহের ৮০% রোগের নিরাময় নির্ভর করে তার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর। যার রূহানী শক্তি যত বেশী সবল, তার দৈহিক স্বাস্থ্য ততবেশী ভাল। আর রূহানী শক্তির চাবিকাঠি হ’ল সর্বদা আল্লাহর উপরে ভরসা করা, তাঁর ইচ্ছাকে হাসিমুখে বরণ করে নেওয়া, নিজেকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখা ও সর্বদা হাসিমুখে থাকা এবং সৎ চিন্তা নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাবার দৃঢ় মনোভাব পোষণ করা।

অনুরূপভাবে হাক্কুল ইবাদ-এর রয়েছে ভিতর ও বাহির দু’টি দিক। মানুষ নিজ পরিবার, সমাজ ও সৃষ্টির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে চরম তৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু যদি এর বিনিময়ে দুনিয়াতে কোন পারিতোষিক কামনা করে, তাহ’লে সেটা হয় স্রেফ যাহেরী সেবা। মানুষের হৃদয়ের গভীরে তা শিকড় গাড়তে পারে না। কিন্তু যদি সেখানে কোন কিছু দুনিয়া লাভের আকুতি না থাকে, এমনকি কৃতজ্ঞতা লাভেরও আকাংখা না থাকে, তাহ’লে সেটা হয় সত্যিকারের নিষ্কাম সেবা। যেটা হ’ল হাক্কুল ইবাদ আদায়ের বাত্বেনী দিক। এর গভীরতা ও নিষ্কুলষতার পরিমাপ কেবল আল্লাহ করতে পারেন এবং কেবলমাত্র তিনিই এর যথার্থ পুরস্কার দিতে পারেন ।

সকল মানুষের মধ্যেই কমবেশী সেবার প্রেরণা রয়েছে। কিন্তু সৃষ্টির সেবার এই প্রেরণা শুধুমাত্র স্বভাবজাত কারণেই টিকে থাকতে পারে না, যতক্ষণ না তার সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রদত্ত পুরস্কার লাভের প্রেরণা যুক্ত হয়। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের তীব্র আকাংখা থেকেই কেবল সুন্দরতমভাবে হাক্কুল ইবাদ আদায়ের সর্বোত্তম প্রেরণা লাভ সম্ভব হ’তে পারে। আর এই আধ্যাত্মিক প্রেরণাই হ’ল পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি, যা বাহির থেকে দেখা যায় না। কেবল অনুভব করা যায়। যেমন বিদ্যুৎ দেখা যায় না, কিন্তু তা অনুভব করা যায় তার কর্মে ও গতিতে।

হাক্কুল্লাহরও রয়েছে যাহেরী ও বাত্বেনী দু’টি দিক। ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ও হজ্জ ইত্যাদি ইবাদত সমূহের বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতাগুলো যেমন ছহীহ হাদীছ মোতাবেক হ’তে হবে, তার বাত্বেনী দিকটাও তেমনি ছহীহ আক্বীদাপূর্ণ হ’তে হবে। যদি খালেছ আল্লাহর জন্য না হয়ে তা অন্যের জন্য হয় অথবা যেখানে ‘রিয়া’ বা লোক দেখানো মনোভাব স্থান পায়, তাহ’লে পুরা ইবাদাতটাই বরবাদ হয়ে যাবে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাত ও অন্যান্য নফল ছালাত আদায় করার মাধ্যমে মানুষকে তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্যের কথা এবং স্রেফ তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। অনুরূপভাবে প্রতিটি শুভকাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আল্লাহর নাম স্মরণ করা এবং শেষে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে তাঁর প্রশংসা করা এবং বিশেষ বিশেষ স্থানে বিশেষ বিশেষ দো‘আ সমূহ পাঠের মাধ্যমে সর্বদা নিজেকে শয়তানের শৃংখল থেকে মুক্ত করে আল্লাহমুখী করার মাধ্যমে মানুষকে প্রতিনিয়ত আল্লাহভীরু হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফলে পশুত্ব পরাজিত হয় এবং মনুষ্যত্ব বিজয়ী হয়। অতঃপর এভাবে অধিকাংশ ‘ইনসানে কামেল’ সৃষ্টি হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীতে সত্যিকারের মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।