হজ্জ ও ওমরাহ

সফরের পূর্বে করণীয়  (الأعمال قبل السفر)

১. (ক) নিজের হালাল মাল থেকে হজ্জ করা (খ) ঋণসমূহ পরিশোধ করা (গ) শরীকদের অংশ বুঝে দেওয়া (ঘ) পরিবারের জন্য অছিয়ত করা বা অছিয়তনামা লিপিবদ্ধ করা ও তাদের প্রতি তাক্বওয়ার উপদেশ দেওয়া (ঙ) খালেছ অন্তরে তওবা করা।

২. সফরের পূর্বে হাজী ছাহেবগণ যাতায়াত ব্যবস্থা ও মক্কা-মিনা-আরাফা-মুযদালিফা প্রভৃতি অবস্থান সম্পর্কে এবং হজ্জের আরকান-আহকাম ও যাবতীয় নিয়ম-কানূন ভালভাবে জেনে নিবেন। বিশেষ করে সফরের দো‘আ, ইহরামের দো‘আ ও ‘তালবিয়াহ’ ভালভাবে মুখস্ত করবেন। এতদ্ব্যতীত ইহরাম বাঁধা, ছালাত জমা ও ক্বছর করা, তায়াম্মুম করা, মোযা মাসাহ করা ইত্যাদি বিষয়গুলির বাস্তব প্রশিক্ষণ নিবেন।

তার জন্য বড় উপদেশ হ’ল এই যে, তাকে সফরের পক্ষকাল পূর্ব থেকে প্রতিদিন সকালে অন্ততঃ ৩ কিঃ মিঃ দ্রুত হেঁটে অথবা বাড়ীতে যোগ ব্যায়াম করে নিজেকে শক্ত ও কষ্টসহিষ্ণু করে নিতে হবে। যা সফরে তাকে বাড়তি শক্তি যোগাবে।

৩. সফরের জন্য যোগ্য, জ্ঞানী, নেককার ও সচেতন সাথী তালাশ করা। একাকী সফর করতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করেছেন।[1] সফরে তিন জন থাকলেও একজনকে ‘আমীর’ নিয়োগ করবেন।[2] সকলে সর্বাবস্থায় একত্রে থাকবেন ও একত্রে সব কাজ করবেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সফর অবস্থায় বিচ্ছিন্ন থাকা শয়তানী কাজ’।[3]

সফরের আদব  (آداب السفر) :

১. বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় পড়বেন-

بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ وَلاَحَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ َبِاللهِ-

উচ্চারণ: বিসমিল্লা-হি তাওয়াক্কাল্তু ‘আলাল্লা-হি ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ’।

অর্থ: ‘আল্লাহর নামে (বের হচ্ছি), তাঁর উপরে ভরসা করছি। নেই কোন ক্ষমতা, নেই কোন শক্তি আল্লাহ ব্যতীত’।[4]

২. নিজের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সকলের নিকট থেকে বিনম্রচিত্তে বিদায় নিবেন এবং পরস্পরের উদ্দেশ্যে নিম্নের দো‘আটি পাঠ করবেন,

أَسْتَوْدِعُ اللهَ دِينَكُم وَأَمَانَتَكُمْ وَخَوَاتِيْمَ أَعْمَالِكُمْ-

উচ্চারণ: ‘আস্তাউদি‘উল্লা-হা দীনাকুম ওয়া আমা-নাতাকুম ওয়া খাওয়া-তীমা আ‘মা-লিকুম’।

অর্থ: ‘আমি আপনার দ্বীন, আপনার আমানত সমূহ ও আপনাদের শেষ আমল সমূহকে আল্লাহর যিম্মায় ন্যস্ত করলাম’।[5] এখানে ‘আমানতসমূহ’ অর্থ ‘ন্যস্ত দায়িত্ব সমূহ’ এবং ‘শেষ আমল’ অর্থ ‘মৃত্যুকালীন সুন্দর আমল  (حسن الخاةمة) ’ (মিরক্বাত)

‘কুম’ সর্বনামটি বহুবচনে এবং সম্মানী ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। তবে একবচনে ‘কুম’-এর স্থলে ‘কা’ বলা যাবে। পরস্পরে ডান হাত ধরে দো‘আটি পাঠ করে পরস্পরকে বিদায় দিবেন।[6]

৩. বিদায় দানকারীগণ তার জন্য উপরের দো‘আটি ছাড়াও নিম্নের দো‘আটিও পাঠ করবে-

زَوَّدَكَ اللهُ التَّقْوَى وَغَفَرَ ذَنْبَكَ وَيَسَّرَ لَكَ الْخَيْرَ حَيْثُ مَا كُنْتَ-

উচ্চারণ: যাউয়াদাকাল্লা-হুত্ তাক্বওয়া ওয়া গাফারা যাম্বাকা ওয়া ইয়াস্সারা লাকাল খায়রা হায়ছু মা কুন্তা’।

অর্থ: ‘আল্লাহ আপনাকে তাক্বওয়ার পুঁজি দান করুন! আপনার গোনাহ মাফ করুন এবং আপনি যেখানেই থাকুন আপনার জন্য কল্যাণকে সহজ করে দিন’।[7]

৪. অতঃপর গাড়ী বা বিমানের সিঁড়িতে পা দিয়ে ‘বিসমিল্লাহ’, উঠার সময় ‘আল্লাহু আকবর’ এবং সীটে বসে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলবেন। অতঃপর নামার সময় ‘সুবহা-নাল্লাহ’ বলবেন।[8]

পরিবহন চলতে শুরু করলে তিনবার আল্লাহু আকবর বলে নিম্নের দো‘আটি পাঠ করবেন-

سُبْحَانَ الَّذِىْ سَخَّرَلَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِيْنَ، وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ- اَللّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِىْ سَفَرِنَا هذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى، اَللَّهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفَرَنَا هذَا وَاطْوِ لَنَا بُعْدَهُ، اَللّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِى السَّفَرِ وَالْخَلِيْفَةُ فى الْأَهْلِ وَالْمَالِ، اَللّهُمَّ إِنِّىْ أَعُوْذُبِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَرِ وَسُوْءِ الْمُنْقَلَبِ فِى الْمَالِ وَالْأَهْلِ،  رواه مسلم-

উচ্চারণ: সুবহা-নাল্লাযী সাখখারা লানা হা-যা ওয়া মা কুন্না লাহূ মুক্বরেনীনা; ওয়া ইন্না ইলা রব্বিনা লামুনক্বালিবূন। আল্লা-হুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফী সাফারিনা হা-যাল বির্রা ওয়াত তাক্বওয়া ওয়া মিনাল ‘আমালে মা তারযা; আল্লা-হুম্মা হাওভিন ‘আলাইনা সাফারানা হা-যা ওয়াত্বভে লানা বু‘দাহূ, আল্লা-হুম্মা আনতাছ ছা-হিবু ফিস সাফারি ওয়াল খালীফাতু ফিল আহ্লি ওয়াল মা-লি। আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিন ওয়া‘ছা-ইস সাফারি ওয়া কাআ-বাতিল মানযারি ওয়া সূইল মুনক্বালাবি ফিল মা-লি ওয়াল আহ্লি’।

অর্থ: আল্লাহ সবার বড় (৩ বার)। ‘মহা পবিত্র সেই সত্তা যিনি এই বাহনকে আমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন। অথচ আমরা একে অনুগত করার ক্ষমতা রাখি না’। ‘আর আমরা সবাই আমাদের প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী’ (যুখরুফ ৪৩/১৩-১৪)। হে আল্লাহ! আমরা তোমার নিকটে আমাদের এই সফরে কল্যাণ ও তাক্বওয়া এবং এমন কাজ প্রার্থনা করি, যা তুমি পসন্দ কর। হে আল্লাহ! আমাদের উপরে এই সফরকে সহজ করে দাও এবং এর দূরত্ব কমিয়ে দাও। হে আল্লাহ! তুমি এই সফরে আমাদের একমাত্র সাথী এবং আমাদের পরিবারে ও মাল-সম্পদে তুমি আমাদের একমাত্র প্রতিনিধি। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে পানাহ চাই সফরের কষ্ট ও খারাব দৃশ্য হ’তে এবং আমাদের মাল-সম্পদে ও পরিবারের নিকটে মন্দ প্রত্যাবর্তন হ’তে’।[9]

৫. গন্তব্যস্থলে অবতরণ করে পড়বেন-

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ-

উচ্চারণ: আ‘ঊযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত তা-ম্মা-তি মিন শার্রি মা খালাক্ব’।

অর্থ: আল্লাহর সৃষ্টবস্ত্ত সমূহের অনিষ্টকারিতা হ’তে আমি তাঁর পূর্ণ কালেমা সমূহের মাধ্যমে পানাহ চাচ্ছি’।[10]

৬. বায়তুল্লাহ থেকে বেরিয়ে দেশে ফেরার সময় তিনবার ‘আল্লা-হু আকবার’ বলবেন। অতঃপর নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়বেন-

لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَشَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، آيِبُوْنَ تَائِبُوْنَ عَابِدُوْنَ سَاجِدُوْنَ لِرَبِّنَا حَامِدُوْنَ، صَدَقَ اللهُ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ، متفق عليه-

উচ্চারণ : লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু; লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লে শাইয়িন ক্বাদীর; আ-য়িবূনা তা-ইবূনা ‘আ-বিদূনা সা-জিদূনা লি রবিবনা হা-মিদূনা; ছাদাক্বাল্লা-হু ওয়া‘দাহু ওয়া নাছারা ‘আবদাহু ওয়া হাযামাল আহযা-বা ওয়াহদাহু।

অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই জন্য সমস্ত রাজত্ব ও তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা এবং তিনিই সকল বস্ত্তর উপরে ক্ষমতাবান। আমরা সফর হ’তে প্রত্যাবর্তন করছি তওবাকারী হিসাবে, ইবাদতকারী হিসাবে, সিজদাকারী হিসাবে এবং আমাদের প্রভুর জন্য প্রশংসাকারী হিসাবে। আল্লাহ সত্যে পরিণত করেছেন তাঁর প্রতিশ্রুতিকে, জয়ী করেছেন তাঁর বান্দা (মুহাম্মাদ)-কে এবং পরাজিত করেছেন একাই সম্মিলিত (কুফরী) শক্তিকে’।[11]

৭. নিজ গৃহে প্রবেশকালীন দো‘আ : প্রথমে ‘বিসমিল্লাহ’ বলবেন। অতঃপর গৃহবাসীর উদ্দেশ্যে সালাম দিবেন।[12]



[1]. বুখারী ফৎহ সহ হা/২৯৯৮; ৬/১৬০।

[2]. আবূদাঊদ হা/২৬০৮; ঐ ছহীহ, হা/২২৭২।

[3]. আবুদাঊদ হা/২২৮৮; মিশকাত হা/৩৯১৪।

[4]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২৪৪৩।

[5]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/২২৬৬, ২২৬৫; মিশকাত হা/২৪৩৬।

[6]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৪৩৫।

[7]. ছহীহ তিরমিযী হা/২৭৩৯; মিশকাত হা/২৪৩৭।

[8]. তিরমিযী, মিশকাত  হা/২৪৩৪;  বুখারী, মিশকাত হা/২৪৫৩।

[9]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৪২০।

[10]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৪২২।

[11]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৪২৫।

[12]. বুখারী, মিশকাত হা/৪১৬১; নূর ২৪/৬১।