ইক্বামতে দ্বীন পথ ও পদ্ধতি

দা‘ওয়াত ও বায়‘আত

‘দাওয়াত’-এর মাধ্যমে সাধারণভাবে জনগণকে দ্বীনের পথে আহবান করা হয়। এই আহবানে যবান, কলম ও আধুনিক সকল প্রকার প্রচার মাধ্যম ব্যবহৃত হ’তে পারে। এর জন্য কখনো একক ব্যক্তিই যথেষ্ট হন। যেমনভাবে বহু নবী একাকী দাওয়াত দিয়ে গেছেন। কিন্তু কোন সাথী জোটেনি। হাদীছে এসেছে যে, ক্বিয়ামতের দিন কোন কোন নবী এমনভাবে উঠবেন যে, মাত্র একজন উম্মত তাঁকে বিশ্বাস করেছে’।[1] বর্তমান যুগে সভা-সমিতিতে বা রেডিও-টিভিতে একাকী বক্তৃতা করে, বই লিখে, ইন্টারনেট-ওয়েবসাইট ইত্যাদি চালু করে এ ধরনের দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে। যদিও তার প্রভাব পড়ে খুবই সামান্য।

পক্ষান্তরে ‘বায়‘আত’ হয়ে থাকে ইসলামী বিধিবিধান মেনে চলার আন্তরিক ও স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গীকারের উপরে। একাকী হৌক বা সম্মিলিতভাবে হৌক ইসলামী বিধানকে নিজ জীবনে ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও বাস্তবায়িত করাই হ’ল বায়‘আতের মূল উদ্দেশ্য। যার চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জান্নাত লাভ।

ইসলামী আন্দোলনে দা‘ওয়াত ও বায়‘আত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কেননা ইসলাম নিঃসন্দেহে প্রচারধর্মী হ’লেও এর মূল উদ্দেশ্য হ’ল মানব সমাজে দ্বীনের বিধান সমূহের বাস্তবায়ন। সেজন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগের সাথে সাথে সম্মিলিত প্রচেষ্টার গুরুত্ব অত্যধিক। সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্য নির্দিষ্ট নেতৃত্বের অধীনে একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী প্রয়োজন। আর সে উদ্দেশ্যেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দা‘ওয়াত কবুলকারী ব্যক্তিদের বায়‘আত ও অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। অথচ বিশ্ব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব হিসাবে তিনি একাই যথেষ্ট ছিলেন তাঁর আনীত দাওয়াতকে তথা আল্লাহ প্রেরিত দ্বীনকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। প্রয়োজনে তিনি স্বীয় নবুঅতী শক্তিবলে ফেরেশতা মন্ডলীকে দিয়ে আবু জাহল, আবু লাহাবের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সহজে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি মানুষের কাছ থেকে গাল-মন্দ খেয়ে মানুষের গীবত-তোহমত এমনকি দৈহিক নির্যাতন সহ্য করে মানুষের দুয়ারেই গিয়েছেন ও তাদের নিকট থেকে স্ব স্ব জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার বায়‘আত ও অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন। কেউ উক্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করে জান্নাতের অধিকারী হয়েছেন। কেউ গোপনে বিরোধিতা করে ‘মুনাফিক্ব’ হয়েছে। কেউ অলসতা করে ‘ফাসিক্ব’ হয়েছে। কেউ প্রত্যাখ্যান করে ‘কাফির’ হয়েছে। শেষোক্ত তিনটি দল জাহান্নামী। যদিও তাদের জাহান্নামে অবস্থানের মেয়াদ কমবেশী হবে।

দুর্ভাগ্য এই যে, সমাজে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ‘ইমারত ও বায়‘আত’-এর এই সুন্নাতী ধারা এখন ছিনতাই হয়ে গেছে কিছু ভন্ড মা‘রেফতী ছূফীদের হাতে। বিভিন্ন বিদ‘আতী তরীকায় তারা লোকদেরকে তাদের মোহজালে আবদ্ধ করছে ও ভক্তির চোরাগলি দিয়ে মুরীদদের দ্বীন-ঈমান ধ্বংস করছে। সাথে সাথে তাদের পকেটও ছাফ করছে। হকপন্থী বলে দাবীদারগণ এগুলির বিরোধিতা করতে গিয়ে রাসূলের এই চিরন্তন সুন্নাতকেই প্রত্যাখ্যান করে বসেছেন। তাদের কেউ কেউ ইমারত ও বায়‘আতকে তাচ্ছিল্য করে বলেন, ‘এটি ছূফীদের তরীকা’। অথচ জামা‘আতবিহীন বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনের সুযোগে শয়তান তাদেরকে অনেক সময় প্রবৃত্তির গোলামে পরিণত করে। তারা সমাজ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে নিজেদের ভালমানুষী যাহির করেন। অথচ সামাজিক প্রয়োজনেই তারা বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠনের আনুগত্য করে থাকেন। অথচ মুসলিম উম্মাহ ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করুক আর অনৈসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করুক, রাষ্ট্রীয় আনুগত্য করার সাথে সাথে তাকে শরী‘আত অভিজ্ঞ আমীরের অধীনে জামা‘আতবদ্ধভাবে সামাজিক জীবন যাপন করতে হবে। তবেই তার জীবনে শৃংখলা ফিরে আসবে এবং বিভক্ত আনুগত্যের বিশৃংখল জীবনের অভিশাপ থেকে তিনি মুক্তি পাবেন। সেই সাথে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ শক্তিশালী হবে।



[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭৪৪ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায়।