ইক্বামতে দ্বীন পথ ও পদ্ধতি

খারেজী আক্বীদা

উপরের বক্তব্যগুলি পরখ করলে চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ)-কে হত্যাকারী খারেজীদের চরমপন্থী জঙ্গীবাদী আক্বীদা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এরা إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ‘আল্লাহ ব্যতীত কারু শাসন নেই’ (ইউসুফ ৪০) এই আয়াতের অপব্যাখ্যা করে হযরত আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ) উভয়কে ‘কাফির’ এবং তাঁর রক্ত হালাল গণ্য করেছিল ও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আলী (রাঃ) তাদের উপরোক্ত বক্তব্যের জবাবে বলেছিলেন,

كَلِمَةٌ حَقٌّ يُرَادُ بِهَا جُوْرٌ، إِنَّمَا يَقُوْلُوْنَ أَنْ لاَ إِمَارَةَ وَلاَ بُدَّ مِنْ إِمَارَةٍ بِرَّةٌ اَوْ فَاجِرَةٌ ‘কথা ঠিক কিন্তু বাতিল অর্থ নেওয়া হয়েছে। এরা বলতে চায় যে, (আল্লাহ ব্যতীত কারু) শাসন নেই। অথচ অবশ্যই শাসন ক্ষমতায় ভাল ও মন্দ সব ধরনের লোকই আসতে পারে’।[1] মনে রাখা আবশ্যক যে, শরী‘আতের কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম বিশেষ করে খুলাফায়ে রাশেদীনের প্রদত্ত ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। পরবর্তীকালে দেওয়া তার বিপরীত কোন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। আলী (রাঃ)-এর দেওয়া ব্যাখ্যা গ্রহণ না করে তাঁর দল থেকে বহু লোক বেরিয়ে যায়। ইতিহাসে এরাই ‘খারেজী’ নামে পরিচিত। ছাহাবায়ে কেরাম নিজেদের মধ্যকার রাজনৈতিক বা বৈষয়িক মতবিরোধ এমনকি আপোষে যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে কখনোই পরস্পরকে ‘কাফির’ বলতেন না। পরস্পরকে মেরে বা মরে গাযী বা শহীদ হবার গৌরব করতেন না। খারেজী ও শী‘আরাই প্রথম এই চরমপন্থী ধুয়া তুলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ফিৎনার সূচনা করে। রাসূলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সৃষ্ট ৭৩ ফেরকার মধ্যে ৭২ ফেরকাই হবে জাহান্নামী।[2] উপরোক্ত দু’টি ফেরকা উক্ত ৭২টি ভ্রান্ত ফেরকার অন্তর্ভুক্ত। শী‘আদের আক্বীদা মতে আলী (রাঃ) ব্যতীত বাকী তিন খলীফা ছিলেন কাফির ও জাহান্নামী (নাঊযুবিল্লাহ)। খারেজীদের আক্বীদা মতে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি কাফির ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তার রক্ত হালাল। আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের নিকটে কবীরা  গোনাহগার মুমিন কাফির নয় এবং তার রক্ত হালাল নয়। একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি মৃতের ন্যায় হলেও তাকে যেমন ‘প্রাণহীন মৃত’ বলা যায় না, তেমনি গুনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণে সাময়িকভাবে ঈমানের দীপ্তি স্তিমিত হয়ে গেলেও কোন মুমিনকে ঈমানশূন্য ‘কাফির’ বলা যায় না। ‘ক্বিয়ামতের দিন রাসূলের শাফা‘আত তো মূলতঃ কবীরা গোনাহগার মুমিনদের জন্যই হবে’।[3]

ছহীহ হাদীছ ও ছাহাবায়ে কেরামের ব্যাখ্যা মতে আহলেহাদীছগণের আক্বীদাই সঠিক এবং সেকারণ বাংলাদেশের মুসলমানরা তাদের দৃষ্টিতে কাফির নয়, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর কোন বিধানকে বিশ্বাসগতভাবে ও মৌলিকভাবে অস্বীকার করে। একইভাবে তাদের জান মাল ও ইযযত অন্যদের জন্য হালাল নয়। অথচ এইসব চরমপন্থীরা কুরআন-হাদীছের বিকৃত ব্যাখ্যা করে পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহকে ও তাদের সম্মানিত আলেম-ওলামাকে কাফির-মুশরিক বলে অভিহিত করছে ও তাদেরকে হত্যা করার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য ক্রমেই পরিবেশ ঘোলাটে করছে। অথচ ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমাজসেবার মুখোশে এদেশের হাযার হাযার নাগরিককে অহরহ ‘খৃষ্টান’ বানাচ্ছে, হিন্দু নেতারা এদেশকে ভারতের দখলীভুক্ত করার জন্য প্রকাশ্যে রাজনৈতিক সেমিনারে বাংলাদেশের পৃথক রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও পৃথক সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব বিলীন করার পক্ষে যুক্তি (?) পেশ করছে, কিন্তু এসব ব্যাপারে এইসব নামধারী মুজাহিদদের (?) কোন মাথাব্যথা নেই। মূলতঃ তারা ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছে এবং নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্বশূন্য করার বিদেশী নীল-নকশা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে।

খারেজীদের সম্পর্কে রাসূলের ভবিষ্যদ্বাণী

চরমপন্থী খারেজী আক্বীদার অনুসারী লোকদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন,

يَخْرُجُ فِي هَذِهِ الْأُمَّةِ (وَلَمْ يَقُلْ : مِنْهَا) قَوْمٌ تَحْقِرُونَ صَلاَتَكُمْ مَعَ صَلاَتِهِمْ وفى رواية : يَحْقِرُ أَحَدُكُمْ صَلاَتَهُ مَعَ صَلاَتِهِمْ، وَصِيَامَهُ مَعَ صِيَامِهِمْ، يَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ يَمْرُقُوْنَ مِنْ الْإِسْلَامِ مُرُوْقَ السَّهْمِ مِنْ الرَّمِيَّةِ يَقْتُلُوْنَ أَهْلَ الْإِسْلَامِ وَيَدَعُوْنَ أَهْلَ الْأَوْثَانِ لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لَأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ عَادٍ

‘এই উম্মতের মধ্যে (তিনি বলেননি, মধ্য হ’তে। অর্থাৎ তারা মুসলিম নামেই থাকবে) এমন এক দল লোক বের হবে, তাদের ছালাতের সাথে তোমরা নিজেদের ছালাতকে হীন মনে করবে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমাদের কেউ নিজেদের ছালাতকে তাদের ছালাতের সঙ্গে এবং তোমাদের ছিয়ামকে তাদের ছিয়ামের সঙ্গে তুলনা করলে তোমাদের নিজেদের ছিয়াম ও ছালাতকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে। তারা সুন্দরভাবে কুরআন তেলাওয়াত করবে। কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা ইসলাম থেকে এমন তীব্র বেগে খারিজ হয়ে যাবে, যেমন ধনুক হ’তে তীর বের হয়ে যায়। ...তারা মুসলমানদের হত্যা করবে ও মূর্তিপূজারীদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দেবে (অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আমি যদি তাদের পেতাম, তাহ‘লে ‘আদ’ জাতির ন্যায় তাদের হত্যা করে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিতাম’।[4]

ছহীহ মুসলিম-এর অন্য বর্ণনায় এসেছে যে,

سَيَخْرُجُ فِىْ آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ أَحْدَاثُ الْأَسْنَانِ سُفَهَاءُ الْأَحْلاَمِ يَقُوْلُوْنَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ يَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ ... فَإِذَا لَقِيْتُمُوْهُمْ فَاقْتُلُوْهُمْ فَإِنَّ فِيْ قَتْلِهِمْ أَجْرًا لِّمَنْ قَتَلَهُمْ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقَيَامَةِ-

‘আখেরী যামানায় একদল তরুণ বয়সী বোকা লোক বের হবে, যারা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর কথা বলবে এবং কুরআন তেলাওয়াত করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না...। তোমরা তাদের পেলে হত্যা করবে। কেননা এদের হত্যাকারীর জন্য আল্লাহর নিকটে ক্বিয়ামতের দিন অশেষ নেকী রয়েছে’।[5]

উল্লেখ্য যে, খারেজীদের বিরুদ্ধে বর্ণিত হাদীছের আধিক্য ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।[6]

বলা আবশ্যক যে, এদের প্রথম যুগের নেতা বনু তামীম গোত্রের যুল-খুওয়াইছেরাহ নামক জনৈক ন্যাড়ামুন্ড ঘন শ্মশ্রুধারী মুসলিম (?) ব্যক্তি ইয়ামন থেকে আলী (রাঃ) প্রেরিত গণীমতের মাল বণ্টনের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘ইনছাফ কর’ এবং ‘আল্লাহকে ভয় কর’- বলে উপদেশ দিয়েছিল। এদেরই বিরাট একটি দলকে হযরত আলী (রাঃ) হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করেছিলেন। এদের লোকেরাই হযরত আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে ‘কাফির’ অভিহিত করে আলী (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল এবং মু‘আবিয়া (রাঃ) ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। ‘জিহাদের’ নামে এদের চরমপন্থী আক্বীদাকে উষ্কে দিয়ে বর্তমানে দেশদ্রোহী কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাদের হীন স্বার্থ উদ্ধারের নেশায় অন্ধ হয়ে গেছে। এদের থেকে সাবধান থাকা যরূরী।


[1]. দ্রঃ লেখক প্রণীত ‘তিনটি মতবাদ’ পৃঃ ২৮।

[2]. ছহীহ তিরমিযী হা/২১২৯; মিশকাত হা/১৭১ ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[3]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫৫৯৮, ৫৬০০ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়।

[4]. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৯৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৬৪২ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায়, ‘মু‘জিযার বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ; মুসলিম ‘যাকাত’ অধ্যায় হা/১৪৭।

[5]. আলী (রাঃ) হ’তে, ছহীহ মুসলিম হা/১০৬৬ ‘যাকাত’ অধ্যায় হা/১৫৪ ‘খারেজীদের হত্যা করায় উৎসাহ প্রদান’ অনুচ্ছেদ ৪৮।

[6]. শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম, তাহক্বীক্ব : সালীম বিন ঈদ আল-হেলালী (সঊদী আরব : দার ইবনে আফফান ১৪১২/১৯৯২), ১/২৮ পৃঃ টীকা-৩।